ওয়াইসী (রহঃ) এর আধ্যাত্মিক জীবন

ওয়াইসী ক্বেবলা কা’বা (রহঃ) এর আধ্যাত্মিক জীবন

মানুষ ও মানবজাতির মঙ্গলের জন্য ঐশ্বরিক শক্তির আলোকে আলোকিত হয়ে যাঁরা জন্ম গ্রহণ করেন তাঁরা নিজেদেরকে কখনই নিজেদের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখেন না। আল্লাহর মহিমা ব্যপ্ত করার জন্য তাঁরা সারা বিশ্ব পরিভ্রমণ করেন। অবশ্য এ কাজ খুব সহজ নয়। কারণ প্রতি পদক্ষেপে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু বাধা দিয়ে রুখতে পারবে না। আল্লাহর মহিমায় তাঁরা ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী হয়ে যতক্ষণ না চুড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হচ্ছেন, তাঁরা সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করবে দুর্বার ইচ্ছাশক্তির দ্বারা। আল্লাহ্ সর্বদাই তাঁদের সাহায্য করেন ও পথ প্রদর্শন করেন।

হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) আল্লাহর কৃপায় আধ্যাত্মিক শক্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য তিনি সারা দেশের নানা ধর্মস্থান পরিভ্রমণ করেন। তাঁহার সারা দেশ পরিভ্রমণ করার মূল উদ্দেশ্য ছিল একজন দীক্ষাগুরু অনুসন্ধান করা যিনি তাঁকে আল্লাহকে দর্শনের পথ প্রদর্শন করবেন যদি তাঁহার আব্বা হুজুর হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ওয়ারেশ আলী হায়াতে থাকতেন তাহলে তাঁহার আব্বা হুজুরই হতেন তাঁহার পীর ও মাশায়েখ। অবশেষে কলকাতায় তিনি এক মহান ধর্মীয় ব্যক্তির সন্ধান লাভ করেন। নাম হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ হাজী গাজী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীও ছিলেন। ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে ১৮২৬-১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত যুদ্ধে তিনি হযরত সাইয়েদ আহমাদ বেলরভির প্রধান সেনাপতি ছিলেন। তিনি হযরত শহীদ আহমাদ বেলরভি’র পক্ষে এই যুদ্ধে অংশ নেন ও ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে (১৮২৬-৩০ খ্রীঃ) ১৯০৩ খ্রীঃ আফগানিস্থানে মায়ার যুদ্ধে আহত হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রসার পশ্চিম দিকে গীর্জার পাশে মিশরী গঞ্জের মুনশী গোলাম রহমান সাহেবের মসজিদে অবস্থান করেন। ইনি হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর চাচাও হচ্ছেন।

তিনি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একজন মহান আধ্যাত্ম শিক্ষালাভের আকুল তৃষ্ণায় ঘুরছেন সে সময় তিনি হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহমাদ বেলরভি’র প্রধান শিষ্য হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ নূর মোহাম্মদ নিজামপুরীর (রহঃ) সান্নিধ্যে আসেন কলকাতায়। এ সময় হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহমাদ বেলরভি’র পূর্ণ সমর্থনে অবিভক্ত বাংলার বহু সূফী, ওলামা, শিষ্য পীর ও অন্যান্য অনেকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন এবং অংশ নেন। শেষ যুদ্ধ সংঘটিত হয় বর্তমান পাকিস্তানের পর্বত পরিবেস্টিত পাঞ্জাবের মরদান জেলার পঞ্চতারে।

হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী (রহঃ) পিতা হযরত শাহ্ সূফী ওয়ারেশ আলী, হযরত সূফী মাওলানা শাহ্ ইসমাইল প্রমুখ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি এই যুদ্ধে হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহমাদ বেলরভি’র সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁদের মহামূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেন। কেবলমাত্র বাংলাদেশের অন্তর্গত চট্টগ্রামের হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) সহ কয়েকজন মানবজাতির মঙ্গলের জন্য সংঘাতিক আহত অবস্থায় বেঁচে যান। যুদ্ধে হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহমাদ বেলরভি (রহঃ) সহ বহু ওলামা দরবেশগণ নিহত হন।

অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কাদরিয়া, চিশতীয়া, নকশবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া ইত্যাদি ত্বরিকাগুলো সমাপ্ত করে আধ্যাত্মিক ফায়েজ গ্রহণ করেন। আধ্যাত্মিক শক্তির মধ্যে সমস্ত ত্বরিকা শিক্ষাই হল সর্বাপেক্ষা কঠিন ও ত্যাগের বিষয়। অতঃপর তিনি ত্বরিকৎ হকিকৎ ও মারফতের সমস্ত শিক্ষা অর্জন করে হযরত শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরীর খলিফা সম্মানে ভূষিত হন। তিনি কোরআন শরীফ ও হাদিস শরীফ থেকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্’র নিকট উপনীত হওয়ার একমাত্র পন্থ হল পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে ভালবাসতে হবে। বিশ্ব শান্তি ও মানবপ্রেম দ্বারাই আল্লাহর ভালবাসা ও আশীর্বাদ লাভ সম্ভব। বাবা ফতেহ আলী ওয়াইসী বাতেনী ভাবে সাত ত্বরিকার খেলাফত প্রাপ্ত হন। পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি ভক্তি এবং তাঁর নির্দেশিত পথই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে পারে। পবিত্র কোরআন শরীফ ও হাদীস শরীফের নিগূঢ় অর্থ তাই।

পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সান্নিধ্য লাভের বাসনায় তিনি উন্মাদের ন্যায় পরিভ্রমণ করতে থাকেন। অতি শৈশবকাল থেকে যৌবনকাল অবধি হৃদয়ে গভীর যন্ত্রণা নিয়ে ভ্রমণ করতে থাকেন। তাঁর সাক্ষাৎ লাভ না হওয়ায় তিনি দিনে দিনে ক্রমেই হতাশ হয়েছেন। অবশেষে তাঁর মনে হল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাক্ষাৎ বিনা মানব জীবনের কোনো মূল্য নেই, সম্পূর্ণ লক্ষ্যহীন মানব জীবনের মুক্তি ও শান্তি অসম্ভব। অবশেষে গভীর মনোবেদনা ও আশাহত হয়ে হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সাক্ষাৎ না পেয়ে হুগলি নদীতে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে বদ্ধ পরিকর হলেন। নির্দিষ্ট দিনে সূর্যোস্তের পূর্বে যদি পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) সাক্ষাৎ না দেন তবে তিনি জীবন উৎসর্গ করবেন। সারাদিন অতিবাহিত হল ক্রমে সূর্যও অস্তমিত হতে চলল, আজই তাঁর জীবনের শেষ দিন। হুজুর মোহাম্মদ (সাঃ) তাঁকে ভালবাসেন না। তাঁর সকল প্রয়াস ব্যর্থ। তিনি গভীর মর্মবেদনা নিয়ে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে হুগলির জলে নিমগ্ন হতে শুরু করলেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করলেন জীবনের অন্তিম মূহুর্ত আসন্ন। ঠিক সেই মাহেন্দ্র ক্ষণে পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কয়েক মূহুর্তের জন্য আবির্ভূত হয়ে তাঁকে আত্মহননের পথ পরিত্যাগ করে জল থেকে উঠে আসতে বললেন। আরও বললেন, মহান ধার্মিকের জন্য এটি সঠিক পথ নয়। সম্মুখে তোমার মহান কর্তব্য অপেক্ষা করছে। তখন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) জিজ্ঞাস করলেন তুমি কি চাও? উত্তরে বাবা ফতেহ আলী বললেন, আমি মনে প্রাণে আপনার দেখা পেতে চাই। যখনই মনে করব তখনই আপনার সাক্ষাৎ চাই, এটা আমার অনুরোধ। আমি আর কিছু চাই না, আমি আপনার ভালবাসা ও আশীর্বাদ নিয়ে মানবসেবা করতে চাই। আপনার আদেশ ও অনুপ্রেরণা পাথেয় করে আমি জীবনের সঠিক পথ প্রদর্শন করিতে চাই। পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) কে জানালেন যে তাঁহার গভীর প্রেম ও ভক্তির প্রার্থনা তিনি মঞ্জুর করেছেন। তাঁহার জীবনের প্রথম ভাগে পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) প্রতি এই ভক্তি সংবাদ ভক্তদের মুখে মুখে চতুর্দিকে পরিব্যপ্ত হয়ে গেল। “দিওয়ানে ওয়াইসী” কাব্যের মধ্যে তিনি এ ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন-
“তানাম বারে হেজরে তু চুনাম যার অ যাবুন গাশতে।
কে জানম তার্ক মিখাহাদ নেমুদান খুনে তান রা॥
ফেরাকে তু বুদ দুশবার অ অসান উমাদে মুর্দান।
নেমুদাম তার্ক, দুশবার অ গেরেফতাম মুর্দার রা॥

অর্থাৎ তোমার বিরহ যন্ত্রণায় আমার দেহ এতই দগ্ধ ও বিনষ্ট হয়ে গেছে যে আমার প্রাণ এখন চায় এ দেহ ঘর ত্যাগ করে চলে যেতে। তোমার বিরহ অসহনীয় কঠিন অথচ তার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক সহজ, তাই কঠিন বিরহ জ্বালাকে বাদ দিয়ে (জীবনকে) বরণ করে নিলাম মরণকে।

তিনি পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আশীর্বাদ লাভের পর আল্লাহ্ ও তাঁহার বাণী মানবের কল্যাণে জন্য সারা বিশ্বে প্রচার করতে থাকেন। এই মহান বাণী বিশ্বের সর্বত্র প্রচারকালে প্রতিটি রাজপরিবার, বিভিন্ন শিক্ষিত ব্যক্তি, নবাবজাদারা, জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে, ভারতের সর্বত্র সকলে এই প্রখ্যাত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে তাঁহাদের হৃদয়ে আসন দিয়ে তাঁহাকে সর্ব্বোচ্চ সম্মান প্রদান করেন। আর তিনি জগতের গরিব ও অভাবী মানুষের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেন।

অতি অল্প সময়ের মধ্যে তাঁহার নাম জগতের আনাচে কানাচে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তাঁহার বার্তা সকলের নিকট পৌঁছে যায়। বিশ্বের সর্বত্র ধর্মীয় শিক্ষিত মানুষজন তাঁহার আধ্যাত্মিক বাণী আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে। সে সময় ভারত এক শ্রেষ্ঠ ধর্মকেন্দ্র রূপে প্রসিদ্ধ লাভ করে। সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ দরবার শরীফ তাঁহার আদর্শ গ্রহণ ও অনুমোদন করেন। তাঁরা ভারতে আসেন অথবা বিশ্বের নানা ধর্মীয় কেন্দ্র থেকে তাঁহার আদর্শ শিরোধার্য করেন।

পশ্চিমে আধ্যাত্মিক জগতের মহা পুরুষগণ আধ্যাত্মিক শক্তি বলে দেখতে পান পূর্ব আকাশে আল্লাহর রাসূল পুনঃ উদিত হয়েছে। এর রহস্য কি জানার জন্য তাঁরা অধীর আগ্রহে দলে দলে পূর্বদিকে পাড়ি জমালেন অর্থাৎ হিন্দুস্থান এসে হাজির হলেন। হিন্দুস্তান এসে দেখলেন “ওয়াইসী ফায়েজ” বিশিষ্ট এক মহা সাধক হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এক মহা জ্যোর্তির ন্যায় বিরাজ করছেন।

এ যুগে আকাশে প্লেন উড়লে ‘রাডার’ যেমন ধরা পড়ে তেমনি আধ্যাত্মিক জগতের সিদ্ধ মহাপুরুষদের ভেতরে (অন্তরে) রাডারের মত তারা সব খবর রাখে। শুধু পৃথিবী কেন আসমান জমিনের সব খবরই তাঁরা রাখেন। এই শক্তি যাঁহারা অর্জন করতে পেরেছে তারাই শুধু জানে এই মহা শক্তির রহস্য, বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

প্রায় সমস্ত ত্বরিকার ইমামদের বংশধরগণ তাঁহার কাছে এসেছিলেন, আল্লাহ্ রাসূলের দেয়া বিশেষ ওয়াইসী ফায়েজ গ্রহণ করার জন্য।

Additional information