ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বার (রহঃ) পারিবারিক জীবন

ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বার (রহঃ) পারিবারিক জীবনঃ

মুর্শিদবাদ জেলার সালারের অন্তর্গত পুনাশি গ্রামের জনাব ইমদাদুল হোসেন যখন তাঁহার দুই সন্তানের শিক্ষার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানান, সে সময় তাঁর অসীম প্রতিভাদীপ্ত জ্ঞান সকলকে বিমোহিত করে। এই সময় তিনি পিতৃব্য মুর্শিদাবাদ জেলার পুনাশি জমিদার গ্রামের জনাব নেজাবৎ হোসেনের কন্যা খন্দকারিনি হযরত ফাতেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। জনাব খন্দকার ইমদাদুল হোসেন ছিলেন তাঁহার আত্মীয়। মুর্শিদাবাদের খারোরা গ্রামে ছিল তাঁহার স্ত্রীর পিত্রালয়। সালার স্টেশন থেকে স্থানটি ছিল ৫ মাইল দূরে। জমিদার জনাব নেজাবৎ হোসেনের শ্বশুর বাড়ি। পুনাশিতে বাড়ি নির্মাণের জন্য তাদের একটি জমি ক্রয় করেন। স্ত্রীর মনোবাসনা অনুসারে তিনি তাঁহার স্ত্রী হযরত ফতেমা খাতুনের জন্য পুনাশিতে একটি একতলা গৃহ নির্মাণ করেন। নিজ স্ত্রীর অনুরোধে তিনি একটি পুস্করিনী, উদ্যান, কৃষি জমি ক্রয় করেন। প্রায় ৯ বিঘা কৃষি জমিতে তিনি একটি বনঔষধীর বাগান নির্মান করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বনঔষধীর গাছ গাছড়া এনে এই বাগানকে মানুষের উপকারের জন্য লাগান। তিনি সেখানে কিছুকাল অস্থায়ী ভাবে বাস করেন। কলকাতার শরহতলী দমদম গবেষণাগারে কাজ করার সময় তিনি সূর্য্য সেন স্ট্রীট ও আমহাট স্ট্রীটের সংযোগ স্থলের উত্তর পাশে মির্জাপুর পার্কের ঠিক মুখোমুখি (বর্তমান শ্রদ্ধানন্দ পার্ক) অপরদিকে মাঠকোঠায় বসবাস করতেন, এখন এখানে একটি হোটেল তৈরী হয়েছে। হাইকোর্টের রেজিষ্টার হিসাবে কাজ করার সময়ও এ মাঠ কোঠায় থাকতেন। তারপর তিনি পার্ক সার্কাস কড়েয়া রোডের আহমাদ কসাইয়ের মসজিদের নিকটবর্তী জনাব বেগবাগান রো এ কুঠিতে স্বপরিবারে বসবাস করতেন। এখানে থাকাকালীন পদচ্যুত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের প্রাইভেট সেক্রেটারী পদ গ্রহণ করেন। পরে পলিটিক্যাল পেনশান অফিসের সুপারেনটেন্ডেট (মীর মুনশীর) পদ গ্রহণ করেন। পলিটিক্যাল পেনশন অফিসের সুপারেনটেন্ডট থাকাকালী তাঁর সঙ্গে দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে দেশ ও জাতির কন্যানের জন্য বহু গোপন আলোচনা হত। তিনি কলকাতা তালতলা ওয়েলীসলী-স্কোয়ারে শাহ্ ওয়ালী-উল্লাহ্ লেনে (১নং ও ৩নং) বিবি সালেটের (সাওলাতুন নেশা) মসজিদ সংলগ্ন কুঠিতে বসবাস করতে লাগলেন। এখানে থাকাকালীন তার বহু ভক্ত আধ্যাত্মিক শিখরের উচ্চ শিখরে উপনীত হয়েছিলেন। তিনি স্বরিবারে এখানে থাকতেন ও উচ্চ সবক দিতেন। তিনি বিবি সাওলাতুন নেসার অর্থ সাহায্যে মক্কাতে একটি মাদ্রাসা সাওলাতিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজও মক্কাতে বর্তমান। কিন্তু সাওলাতুন নেসার সঙ্গে হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী কি সম্পর্ক ছিল আজও জানা যায় নি। তবে বিভিন্ন সূত্র ধরে জানা যায় উনি ওনার কোন চাচাতো ভাইয়ের কন্যা হবেন।

পলিটিক্যাল পেনশান অফিসের সুপারিনডেন্ট পদ নিয়ে একটি একটি ঘটনা আছে। এ সময়ে ইংরেজরা এ পোষ্টে নিয়োগ হত। একদিন হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বা কোন একটি কাজ নিজে সুপারিনটেনডেন্টের চেম্বারে ঢুকেছেন। তিনি দেখলেন ইংরেজ সুপাারিনটেনডেন্ট টেবিলের উপর পা তুলে বসে আছেন। তাঁকে দেখেও ইংরেজ অফিসারটি পা নামালেন না। হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী কিছু না বলে কাজ সমাধা হয়ে গেলে এমন একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন, ঐ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। পরে জ্ঞান হলে এ সাহেব হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) কাছে শুধু ক্ষমা চাইলেন না, নিজে এ পোস্ট ছেড়ে দিয়ে সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বাকে (রহঃ) এ পদে বসিয়ে যান। এই রকম বহু ঘটনা আছে যা ভাবতে বিস্ময় লাগে। পরবর্তী প্রজন্মেরা এই সব দেখেই শিখেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার ভাষা। তাঁহার স্ত্রী খন্দ কারিন্দি হজরত ফাতেমা খাতুন অতিশয় ভদ্র ও নম্র স্বভাব নারী ছিলেন। তিনি খুব সহজ সরল জীবন অতিবাহিত করতেন। তিনি তাঁহার স্বামীর অনুগত ছিলেন জীবনে কখনও স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করেন নি। তিনি এক মাসব্যাপী রোজা পালন করতেন। তিনি খুব দয়া ও দানশীলা নারী ছিলেন। আল্লাহর করুণায় তিনি অশেষ প্রতিভার অধিকারিনী ছিলেন। হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) পরলোক গমনের পর তিনি মুর্শিদাবাদের শাহ্পুরে চলে আসেন। এখানেই তাঁহার মৃত্যু হয় দীঘির পাড়ে (পুনাশীর) তাঁকে সমাধিস্থ করেন। তাঁহার পুত্র সাইয়েদ গোলাম মোস্তাফা ১৩০৮ বঙ্গাব্দে ৫ই মাঘ ইন্তেকাল করেন।

হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহম্মদ আলী (রহঃ) তাঁহার লেখা নূরেহক্ব গঞ্জেনূর গ্রন্থে তাঁহার পীর মার সম্বন্ধে তারিফ করতে গিয়ে লিখেছেন-

“শশী হেন মাতা মম পীর আম্মাজান।
বেলায়েতর নূরে যেন পূর্ণিমান চাঁন॥
পৃথিবী ত্যাজিয়া মাতা ফকির হইয়া।
পরকালে গঞ্জেপুরী নিছেন ভরিয়া॥
করিবে আকাশ ব্যাখ্যা কেমনে বাউন।
জগত মাতা যেন তিনি ফাতেমা খাতুন॥
বাক্য সিদ্ধি পৃথিবীতে দেখ যদি ভাই।
সুবচনি আম্মা হেন আর বুঝি নাই॥”

হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এরে চার সন্তান ছিল । দুই পুত্র ও দুই কন্যা। তাঁহার প্রথম পুত্রের নাম হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ গোলাম মোস্তফা আলী। বাংলা, আরবি, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় তাঁহার ছিল বিশেষ ব্যুৎপত্তি। ইংরেজি লেখা ও পড়ায় তাঁহার ছিল স্বাভাবিক প্রবণতা। তিনি সে সময় ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘মুসলিম ক্রনিক্যাল’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। মাতৃভাষার মতো উর্দুতে তাঁহার দখল ছিল। তিনি তাঁহার পিতার নিকট থেকে হাকিমি চিকিৎসা ও অন্যান্য আধ্যত্মিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি তাঁহার পিতার পর পলিটিক্যাল পেনশান বিভাগে সুপারিনটিনডেন্ট অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি ছিলেন নির্লোভ, উদার, সরল ও দয়াপ্রবণ ব্যাক্তি। তাঁহার স্ত্রীর নাম ছিল খন্দ কারিনি ওম্মাতুল বা রাহুল। মৃত্যুর পর তাদের পুনাশি গ্রামে দীঘির পাড়ে তাঁহার মায়ের পাশে সমাধিস্ত করা হয়। কিন্তু স্থানটি সঠিকভাবে চিহ্নিত না থাকায় হযরত ওয়াইসী ভক্তবৃন্দ অথবা জনসাধারণের নিকট সে সমাধিস্থল ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেছে।

হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ ওয়াইসী (রহঃ) দ্বিতীয় পুত্র হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আলী মাত্র সাত বৎসর বয়সে পিতার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শৈশবেই ঐ পুত্রের মৃত্যু হয় কলকাতায়। তাঁহার তৃতীয় সন্তান কন্যা নাম সাইয়েদা জহুরা খাতুন।

হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) চতুর্থ সন্তানও কন্যা। তাঁহার নাম সাইয়েদা রাবেয়া খাতুন। মাত্র ১২ বৎসর বয়েস তাঁহার মৃত্যু হয়। তিনি খুব ধার্মিক ও দয়াশীলা ছিলেন। তিনি নামাজ, রোজ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে আল্লাহ সাধনা করতেন।

সে যুগের বহু মনীষী দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বার দরবারে আসতেন দেশ ও জাতির কল্যাণময় আন্দোলনে রায় মশায়ওরা নেওয়ার জন্য। স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো মহাপুরুষ তাঁহার দোয়া নেওয়ার জন্য তাঁহার কাছে এসেছিলেন।

আজকেও তাঁর মর্যাদা ঐতিহাসিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইংল্যান্ডে তাদের তৈরী ম্যাপের মধ্যে কলকাতা মালিকতলা মুনশিপাড়া লেনের ও হাওড়া মুনসির হাট ধসার ম্যাপে স্থান দিয়েছেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় ভারতর্ষের মানুষ দেশভাগের ফলে একটা অশুভ চক্রান্তে দেশের ম্যাপ থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে নাম ও তার ইতিহাস সহ সবকিছু শুধু আত্মসাৎ করে ক্ষান্ত হননি, বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। সত্যিই কি মর্মান্তিক ! ওই সময়ে ইংল্যান্ডের মহারাণীর কাছে ঐ দেশের বিখ্যাত গণকার গণনা করে জানালেন ব্রিটিশ রাজত্বে ভারতবর্ষের মধ্যে বাংলায় হাওড়া ও কলকাতায় এক মহা আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ বিরাজ করছেন। তিনি এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ সাধুপুরুষ। তাঁহার সুবিধা-অসুবিধা লক্ষ্য রাখতে রাণী ভিক্টোরিয়াকে অনুরোধ করেন। তাঁহার কাজকর্মে যাতে কোনো অসুবিধা সৃষ্টি না হয় তা লক্ষ্য রাখতে মতামত দেন। যদি তাঁহার অন্তরে দুঃখ বা ব্যথা লাগে তাহলে এই সুবিশাল ব্রিটিশ রাজত্ব ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ইংল্যান্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়া ভারতে থাকা বড়লাট মারফত দুজন দূত পাঠিয়েছিলেন হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বার দরবারে এটা একটা ইতিহাস। স্যার ম্যালকম মাওলানা কারামত আলী জৈনপুরীকে হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলার দরবারে পাঠাতেন এটাও যেমন ইতিহাস, তেমনি হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বা সিপাহী বিদ্রোহের পর দেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কিভাবে লাঘব করা যায় তার দাবী নিয়ে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের  প্রধান প্রতিনিধি হিসাবে লন্ডনে গিয়াছিলেন এও সত্য। কিন্তু আজ অনেকে তা জানেন না। তিনি ৭ বৎসর বয়সে কোরাআনে হাফেজ হয়েছিলেন। ১০ বৎসর বয়সে কোরআনে কারী হয়েছিলেন। তিনি কখনও অন্যান্য বালকদের ন্যায় খেলাধুলা করে সময় নষ্ট করতেন না। চার বৎসর বয়স থেকে নামাজ রোজ মোরাকাবা, মোশাহেদা, কোরআন শরীফ তেলায়াত নিয়মিত করতেন। আশুরার দিনে রোজা রাখতেন। কারবালার নিদারুণ বেদনার স্মৃতির কথা মনে করে অঝর নয়নে কাঁদতেন। লন্ডনে গোল টেবিল মিটিং এ ভিক্টোরিয়া কাছে ওয়ারেন হোস্টিংস এর দেশের মানুষের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলকাতা ও লক্ষৌ নগর দেওয়ানী আদালত থেকে তার শাস্তির অর্ডার কপি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জলন্ত কন্ঠে দেশের মানুষের উপর অত্যাচারের তথ্য ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেই সময়ে রাণী ভিক্টেরিয়া ভারত থেকে ওয়ারেন হোস্টিংসকে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

Additional information