হযরত মা জহুরা (রহঃ) এর জীবনী

হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বার (রহঃ) কন্যা মা জহুরার জীবনীঃ

হযরত রাবেয়া বসরী (রহঃ) যেরূপ মারইয়ামে সানী আখ্যা পেয়েছিলেন- সেইরূপ হযরত জহুরা খাতুন (রহঃ) কে ফাতেমায়ে সানী দ্বিতীয় ফাতেমা হযরত ওয়সীর মুরিদ ও খলিফারা আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁহার প্রতি ইহা অত্যুক্তিমূলক সম্ভাষণ নয়, কারণ আধ্যাত্মিকতায় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যর ক্ষেত্রে তিনি সুমহান উচ্চস্তরে পৌঁছিয়াছিলেন।

হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী হুজুর (রহঃ) তাঁহার এই মোহতারামা কন্যার উপাধি দিয়াছিলেন দোরে মাকনুন অর্থাৎ গুপ্ত মতি। হযরত ওয়াজেদ আলী শাহ্ (রহঃ) জামেয়ার ফায়েজ হাসিলের সময় তাঁহার এই মহতী কন্যার উছিলা ধরিয়া মোরাকাবায় বসিতেন। কত সুউচ্চ আধ্যাত্মিক মর্তবা যে তিনি লাভ করিয়াছিলেন ইহা তাঁহার জ্বলন্ত প্রমাণ।

তিনি (হযরত দোরে মাকনুন) ছিলেন জামানার কুতুবুল আকতাব অর্থাৎ, অত্যন্ত উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন আল্লাহর মহান অলি। উল্লেখ্য, কুতুবুল এরশাদ এবং কুতুবুল আক্তাব ত্বরিকতের পীরগণের অত্যুচ্চ দুইটি আধ্যাত্মিক পদবীর নাম। কুতুবুল এরশাদ দুইশত বৎসরে একজন হন এবং কুতুবুল আক্তাব একশত বৎসরে হন একজন। হযরত মা জহুরা খাতুন (রহঃ) ছিলেন কুতুবুল আক্তাব পদের গৌরবোজ্জ্বল অধিকারিণী। হযরত ইমাম মাহদী আলাইহিচ্ছালাম জাহির হওয়া পর্যন্ত এই দুই নিসবতের ধারা বলবৎ থাকিবে। উক্ত তথ্যটি হযরত সাইয়েদ ওয়াজেদ আলী রহমাতুল্লাহ আলাইহের প্রমুখ্যাত অনুসরণে তদীয় খাদেম শাহ্ আহম্মদ আলী মোজাদ্দেদী (রহঃ) সাহেব কৃত “ছায়েফোল হোজ্জাৎ” নামক কিতাবের ৮৩ পৃষ্ঠার বর্ণনা হইতে উল্লেখ করা হইয়াছে। ‘কারামতে কামেলীন’ নামক গ্রন্থের ৩৬ পৃষ্ঠায় হযরত ওয়াজেদ আলী শাহ্ (রহঃ) এর প্রমুখ্যাত উল্লেখ পূর্বক বলা হইয়াছে যে, হযরত দোরে মাকনুন রাহমাতুল্লাহ্ আলাইহার পদবী ছিল ‘কুতুবুল আকতাব’ যাঁহার কাজের পরিচালনার আলো শত বৎসর পর্যন্ত কায়েম থাকিবে।

আধ্যাত্মিক পদমর্যাদার এক ধাপ পশ্চাতে থাকিলেও হযরত দোরে মাকনুন সাহেবা নেসবতে জামেয়াতে এমন পরিপক্ক ছিলেন যে, তাঁহার মহান পীর-পিতা হযরত ওয়াইসী হুজুর পাক (রহঃ) অনেক সময় তাঁহার নিকট হইতে নেসবতে জামেয়ার জন্য পরামর্শ লইতেন।

হযরত দোরে মাকনুন রহমাতুল্লাহ আলাইহার অসংখ্য কারামত ছিল।

হযরত দোরে মাকনুন রহমাতুল্লাহ আলাইহার কারামতের যে বর্ণনাটি এখানে দিতেছি তাহা হযরত ওয়াইসী হুজুরে পাকের প্রমুখ্যাত অনুসারে কারামাতে কামেলীন নামক কিতাবের ৩৬ পৃষ্ঠায় লেখা হইতে উল্লেখ করা হইয়াছে। যেখানে হযরত ওয়াইসী হুজুরে পাক (রহঃ) বলিয়াছেনঃ হুগলীতে একবার প্রচন্ড ঝড় তুফান হয়। তাঁহাতে জানালা দিয়া ঘরের মধ্যে বৃষ্টির ছিট, বাতাসের বেগ পৌঁছিতে থাকে। এমন দুর্যোগের সময় প্রাণতুল্য অসূর্য্যস্পশ্যা কন্যা জহুরা খাতুনকে না দেখিতে পাইয়া সকল ঘরে তল্লাশ করিলাম। কোথাও তাঁহার সন্ধান না পাইয়া হতাশ মনে খোদার কাছে কান্দিতে থাকিলাম। ঝড়-বৃষ্টি থামিয়া গেলে কার্য বিশেষ ঘরের ছাদের উপরে যাইব আশায় সিঁড়ি বাহিয়া কিছু উপরে উঠিতেই সামনে সিঁড়ির উপরে কন্যাকে দেখিলাম; হতভম্ব ভাবে বলিলাম, ‘মা! কোথায় ছিলে?’ উত্তর করিল ‘ছাদের উপরে ছিলাম।’ আশ্চর্য হইয়া কহিলাম, ‘মা! ঝড় বৃষ্টিতে জানালা দিয়া ঘরের ভিতরে বৃষ্টির ছিটা প্রবেশ করিল, এত ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ছাদের উপরে কিভাবে ছিলে আর কাপড় চোপড় তো সব শুক্নো দেখিতেছি, এ কেমন কথা! সে বলল, ‘আব্বা! আমি মিথ্যা বলিতেছি না।’ তখন তাঁহাকে লইয়া ছাদে গিয়া দেখিলাম, “(যে স্থানে তিনি ঝড় বৃষ্টি সময় বসিয়া ছিলেন) সেই স্থানটি পানি চলার স্থান হইলেও এদিক ওদিক দিয়া পানি নিষ্কাশন হইতেছে, বসার স্থানটি শুকনো আছে।” তখন হযরত দোরে মাকনুন রহমাতুল্লাহ আলাইহার বয়স ছিল মাত্র নয় বৎসর।

খোদা প্রেমে আত্মহারা হযরত দোরে মাকনুন রহমাতুল্লাহ আলাইহার সংসারের প্রতি মোটেই আসক্তি ছিল না। বিবাহের প্রস্তাবে প্রথমে তিনি অসম্মতি জ্ঞাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু স্বীয় মহান পীর পিতার উপদেশে পরে তিনি বিবাহে সম্মত হন এবং মুর্শিদাবাদ জেলা (পশ্চিমবঙ্গ) শাহ্পুর গ্রামের বিত্তশালী জমিদার সাইয়েদ মহঃ হোসেন সাহেবের সঙ্গে তাঁহার শাদী মোবারক হয়।

হযরত দোরে মাকনুন (রহঃ) বাংলা ১৩৪৮ সনে ইন্তেকাল ফরমান এবং শাহ্পুরে (মুর্শিদাবাদে) স্বীয় গৃহের আঙ্গিনায় মাদফুন হন;

ওয়াইসী পীরের মত তিনিও নিজের প্রচার কখনও চাইতেন না। তিনি জীবন নির্বাহ করতেন অবিকল পিতার মতই। মুর্শিদাবাদের জমিদার হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ মোহাম্মদ সাইদ হাসানের সঙ্গে বিবাহ হয়। হযরত সাইয়েদ হোসেনের ফার্সী, আরবী ও উর্দু ভাষায় পান্ডিত্য ছিল। প্রথম স্ত্রী ইন্তেকালের পর তাঁহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন হযরত সাইয়েদা জহুরা খাতুন। তাঁহার দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান ছিল। তাঁদের নাম হযরত সাইয়েদা সিদ্দিকা খাতুন ও হযরত সাইয়েদা হাফেজা খাতুন। তাঁহার শেষ সন্তান হযরত সূফী সাইয়েদ ইহসান আহমাদ। মৃত্যুর আট দিন আগে তিনি পুত্রকে জিজ্ঞাসা করেন আজকের তারিখ ও বার কি? সে কথা জানার পর তিনি বলেন আর মাত্র আট দিন তাঁহার জীবনের। তিনি আদেশ দেন এখন থেকে তাঁহার শয়নকক্ষের দরজা সর্বদা যেন খোলা থাকে। এই কথা বলে সকলের সঙ্গে কথা শেষ করে তিনি চিরকালের মত কথা বলা বন্ধ করে দেন। শেষের এই আট দিন তিনি পরম করুনাময় আল্লাহর প্রার্থনায় নিজেকে সমর্পন করেন। অবশেষে ১৭ই আষাঢ় ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে তাঁহার মহান আত্মা চিরকালের মতো বিদায় নিয়ে চলে যায়। তাঁহার মাজার শরীফ মুর্শিদাবাদের সালার শাহ্পুর গ্রামে অন্দপুকুর কবর স্থানে আজও বর্তমান।

কারামতঃ

একদিন হযরত ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বা তাঁহার কন্যা হযরত জহুরা খাতুনকে পিকদান পরিষ্কার করতে অনুরোধ করেন। জহুরা খাতুন (রহঃ) সেই পিকদানি পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখেন থুথুর পরিবর্তে কীটপূর্ণ পিকদানি। কীটগুলি আল্লাহ রবে চিৎকার করছিল। এই দৃশ্য দেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্য হতবাক হয়ে যান। আল্লাহ আল্লাহ আওয়াজ ওঠা পবিত্র তাঁহার আব্বার থুথুগুলো মাটিতে ফেলার সাহস পেলেন না। তারপর তিনি সমস্ত পিক্দানির থুথুগুলো খেয়ে ফেলেন এবং পিকদানি জিভ দিয়ে পরিষ্কার করে পিতার সামনে সেটি রাখেন। হযরত ওয়াইসী ঐশ্বরিক শক্তিবলে সবকিছু উপলব্ধি করতে পারলেন। তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। আর বললেন, ‘আমি এভাবেই তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম। আমি আশীর্বাদ করছি সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তোমাকে সর্বদা সাহায্য করবে। তুমি আমার প্রদত্ত সকল ক্ষমতা আয়ত্ব করেছ এই পরীক্ষাই তা প্রমাণ করে। আমার মৃত্যুর পর তুমি হবে আমার যথার্থ উত্তরাধিকারী হবে। তোমার আধ্যাত্ম শক্তি সাহায্য ব্যতীত আমার কোনো শিষ্যই ‘নেসাবাতে জামিয়া’ অর্জন করতে পারবে না।’

হযরত মা জহুরা (রহঃ) ও তাঁহার পিতার হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর অনেক জীন শিষ্য ছিল। (মহান আল্লাহ মানুষ ও জ্বীন জাতিকে ইমান ও জ্ঞান দান করেছেন।)। একদিন মধ্যরাত্রে কয়েকজন জ্বীন মা জহুরাকে অনুরোধ করেন তিনি যেন তাদের ‘জ্বীন দেশে’ পদার্পণ করেন। মা জহুরা খাতুন তাদের সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ওযু ও তাহাজুত নামাজ শেষে তারা তাদের সিংহাসনে বসিয়ে মা জহুরা খাতুনকে তাদের দেশে নিয়ে গেলেন। সেখানে তাঁহার জ্বীন শিষ্যরা অনেক প্রাতঃরাশ দিলে তিনি মাত্র অল্প কিছু গ্রহণ করলেন। তারপর তিনি নিজের দেশে ফিরতে চাইলে তাঁহার তৎক্ষণাৎ মা জহুরা খাতুনকে শাহ্পুর গ্রামে হুজরা শরীফে পৌঁছে দিলেন। মা জহুরা সম্পর্কে এছাড়া আরও অনেক অলৌকিক ঘটনা রহিয়াছ্।

 

Additional information