সূফীবাদের তাৎপর্য

সূফীবাদের তাৎপর্য

উনবিংশ শতাব্দীর মহান নেতা শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) গভীর জ্ঞান সম্পর্কে আলোচনার আগে সূফীবাদ বিষয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। ইসলাম ধর্ম থেকেই সূফীবাদের সৃষ্টি বলে ধারনা করা হয়। ইসলামের প্রকৃত অর্থ কী তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ইসলাম ধর্মের শুরু পয়গম্বর রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) থেকে নয় হযরত আদম (আঃ) থেকে। কাজেই মানব জাতির জন্মলগ্ন থেকেই ইসলামের সূত্রপাত। পবিত্র কোরানের ব্যাখ্যা অনুসারে যুগ যুগ ধরে পরম করুনাময় আল্লাহ্ এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দুই লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বরকে প্রেরণ করেছেন বিশ্ব সৃষ্টির মানব জাতির কল্যানের উদ্দেশ্যে।

পবিত্র কোরআন পাঠে আরও জানা যায় যে, নানা সংকটময় মূহুর্তে মানবজাতির শান্তি এবং ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য পরম করুনাময় আল্লাহ্ তাঁর পয়গম্বরদের দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির মধ্যে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সৃষ্টির পরিপূর্ণ সুখের জন্য তাঁর মহান আশীর্বাদ বর্ষণ করে থাকেন। মানব সমাজকে অন্ধকার মনের অজ্ঞতা, শান্তি, প্রগতি এবং শ্রীবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে নানান উপলক্ষে, নানান স্থানে, নানা ভাষায় পয়গম্বরের আবির্ভাব হয়েছে। তাঁরা একই ধর্ম কথা আল্লাহর আশীর্বাদ পুনরাবৃত্তি করেছেন কিন্তু মানুষরা ভুল পথে চালিত হয়ে বা কালের রূপান্তরে বিভিন্ন জাতি, সম্প্রদায় ও ধর্মের জন্ম দিয়েছেন, আল্লাহ্ নন। আল্লাহ্ আমাদের সৃষ্টি করেছেন কিন্তু কোন জাতি সৃষ্টি করেন নি। কোরানের নির্দেশ হল, পরমশক্তিমান আল্লাহ্ বিভিন্ন সময়ে যে সব পয়গম্বর বা দূত পাঠিয়েছেন তাঁদের প্রতি আগমনের যেন পূর্ণ বিশ্বাস আমরা রাখি এবং তাঁদের শ্রদ্ধা করি। সকল ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্য এক। সর্বশেষে পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ধর্ম কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, সকল কল্যাণকামী মানুষের জন্য। ধর্ম কেবল কোন নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য নয়। সেই সকল ব্যক্তিই যথার্থ ধর্মীয় পুরুষ যারা শান্তিকামী, পরমশক্তিমানের ঐশী বাণী মান্য করে, তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে আর তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসে। সকল ধর্মীয় গ্রন্থের মিলন সেতু হল পবিত্র কোরআন। সব ধর্মের মানুষের জন্য মানব জীবনের পরিপূর্ণ নিয়মবিধি হল কোরআন। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন যে সব পয়গম্বর  (দেবদূত) আমার আগে এসেছেন পৃথিবীতে তাঁরা আমার বড় ভাই, সুতরাং বড় ভাইকে যেমন সম্মান করে সেইরূপ তাদের সম্মান করবে।

পরম শক্তিমান আল্লাহ যখন মানুষ সৃষ্টির বাসনা পোষণ করলেন তখন স্বর্গের ফেরেস্তারা দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, “আমরা আপনার সকল ধর্মাচরণ করছি এবং আপনার সমস্ত আদেশ পালন করছি। তবুও আপনার মানুষ সৃষ্টির প্রয়োজন কি? ফেরেস্তারা আরও বলেছিলেন, “মানুষ মানুষে সংঘর্ষ করবে, অশান্তি সৃষ্টি করবে, পৃথিবী ধ্বংস করবে এবং আপনার আদেশ অমান্য করবে।” কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেছিলেন। আল্লাহ্ তাঁর নির্দেশে সকল বস্তু ন্যায্য ও সঠিক ভাবে সৃষ্টি করলেন। কিন্তু মনুষ্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় নির্দেশিত আদেশ ছাড়াও নিজ গুনাবলী শক্তি প্রদান করেছিলেন। তিনি মানুষকে তাঁর সকল লুক্কায়িত গুনাবলী সম্পদ দিয়েছেন। তিনি তাঁর কোন ধর্মগ্রন্থে একথা বলেননি যে তাঁর সম্পদ কেবল মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টন বা অন্যদের জন্য। ঐশ্বরিক শক্তি সকল জাতি ও ধর্মমতের মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সূফীবাদীগণ এই উপদেশই দিয়েছেন। আমরা পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে এ শিক্ষা পাই। এছাড়া অতীতের পয়গম্বর ও হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এবং পবিত্র কোরআন শরীফ ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ সমূহ থেকেও  শিক্ষা লাভ বারে।

পবিত্র কোরআন শরীফ বিশ্বাস করে না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। তাঁরাই হলেন প্রকৃত অর্থে সিদ্ধ পুরুষ, যারা সকল পয়গম্বর কে বিশ্বাস ও স্বীকার করবে। যেসব পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর পূর্বে দুনিয়ার আবির্ভূত হয়েছেন, এদের কাউকে অস্বীকার করা চলবে না, ইহাই কোরানের নির্দেশ। আপনি না মানতে পারেন অস্বীকার করা চলবে না। সূফীরা যুগ যুগ ধরে এইসব উপদেশ দিয়ে এসেছেন। এই মহান বানীর দ্বারা মানব সমাজ যুগে যুগে আকৃষ্ট হয়েছে। তাঁরা সমগ্র মানবকুল কে প্রাণ দিয়ে তাঁদের প্রেম ও আশীর্বাদ বিলিয়েছেন।

আধ্যাত্মিক শক্তি, জ্ঞান ও সহাবস্থানের মধ্যে দিয়ে কিভাবে এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকা যায় সুফিরা এই শিক্ষা দিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে মানুষ সংকীর্ণ স্বার্থ ও সংকীর্ণ লক্ষ্যে পৌছানো জন্য সর্বদা পরস্পর কলহ বিবাদে লিপ্ত। মানুষের মধ্যে প্রকৃত আত্মত্যাগের বড়ই অভাব। বর্তমানে সেই প্রকৃত সূফী যে সদা সত্যও যথার্থ কথা বলেন এবং সঙ্কটপূর্ণ মূহুর্তে সঠিক পথে চলেন। যারা মানুষকে ভালোবাসেন মানুষের মঙ্গলকামনা করেন এবং নির্দিষ্ট পথে নিজ কর্তব্য সম্পন্ন করেন। এই দুনিয়ায় যথার্থ সুফীরূপে তাঁরাই গণ্য যাঁরা কেবলমাত্র নিজ সম্প্রদায় সমাজ ও জাতি নয় তামাম প্রগতি ও অগ্রগতির জন্য দায়বদ্ধ বা চিন্তা করেন।

আজকে নামের পাশে অনেকেই সূফী তক্মা লাগাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশ সূফী চিন্তা ভাবনার কোন নিয়মকানুন অনুসরণ করে চলেন কি না তারাই জানেন। তাদের কার্য্যকলাপ দেখে সূফীদের চিন্তাভাবনা নিয়ে অনেকেই গুলিয়ে ফেলছেন বা তাদের ক্রিয়া কলাপ থেকে সূফীদের বিরূপ মন্তব্য করছেন কিন্তু প্রকৃত সুফীরা শুধু কুতুব খানার মাওলানা ও হুজরার মধ্যে সীমবিদ্ধ ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন ময়দানে মর্দ্দে মোমেন ও মোজাহেদ। 

বহু লেখক ও গবেষকদের গবেষণায় দেখা যায়,  তারা সুফীদের অর্ন্তনিহিত ঐশ্বরিক শক্তি ও গুনাবলী সম্পর্কে গভীরের প্রবেশ না করে, তাঁরা শুধুমাত্র লেখার মাধ্যমে তাঁদের দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন, কখনই ভেতরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করেননি। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা সূফীবাদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অবাব হেতু সঠিক তথ্যতুলে ধরতে পারেননি। তাঁদের অধিকাংশই সূফীদের ধ্যানের গভীর শক্তি সম্পর্কে ক্ষীণ ধারণার জন্য। এজন্য তাঁরা বিষয়টি দুরুহ করে তুলেছেন কিন্তু প্রকৃত সূফী সর্বদায় নিজ আধ্যাত্মিক জগতে অবস্থান করে বা সমগ্র মানুষের মঙ্গলের জন্য জ্ঞান বিতরণ করেন জাতির শান্তি ও উন্নতি বিধানের জন্য। আসলে সূফীবাদের উপর গবেষণা যারা করেছেন বেশীর ভাগ মানুষ দার্শনিক দৃষ্টি সম্পন্ন নয়। তাদের ভেতরে মালমশলা থাকুক না থাকুক তারা এ কাজে হাত দিয়েছেন এতেই এত ঝামেলা। 

প্রকৃত সূফী কথাটা আসহাবুস সুফফাঃ সুফফা শব্দের অর্থ শামিয়ানা বা এমন একটি উচু স্থান যা ঘাস বা উলুখড়ের ছাউনি দ্বারা আচ্ছাদিত। মদিনার মসজিদ-ই-নববীর দিকে অবস্থিত ছিল। ছাউনিটিতে ঐ সমস্ত মোহাজীরগণ আশ্রয় গ্রহণ করতেন, যাঁদের কোন ঘরবাড়ি ছিল না এবং কোন রূপ জীবনধারণের উপায় ছিল না। তাঁদের সম্বন্ধে হাদীশে “আদ-আফুল ইসলাম” (ইসলামের মেহমান) পদটি ব্যবহৃত হয়েছে সংস্কৃতিবান জ্ঞানী-গুনীজন নিশ্চয়ই মেহমানদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে যথাযথ মূল্যায়ন করেন। আরব সভ্যতার এটি একটি বিশেষ লক্ষণ।আসহাবুস সুফ্ফাগণ তাঁদের অধিকাংশ সময় রাসূল (সাঃ) এর নিগুঢ় সংশ্রবে কাটাতেন এবং এলেম চর্চা ও আল্লাহর যিকিরে লিপ্ত থাকিতেন। তাসাউফ ও যুহদের (ইলমে মারেফত) গ্রন্থাবলীতে তাঁদেরকে যুহূদ ও তাকওয়ার নমুনা হিসাবে পেশ করা হয়েছে বুযুর্গগণ ইবাদতের আদর্শ বিশ্লেষণে আসহাবুস সুফফাকে বিশিষ্ট স্থান দিয়েছেন। কোরআনের সূরা বাকারাহ্ ২৭৩-২৭৪ আয়াত আসহাবে সুফফার সহিত সম্পর্ক যুক্ত। আসহাবে সুফফা ঐ সকল সাহাবী যাঁহারা শুধু মাত্র এবাদত বন্দেগী ও রাসূল পাক (সাঃ) এর শিক্ষা গ্রহণে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সর্বদা রাসূল পাক (সাঃ) এর  দরবারে উপস্থিত থাকতেন এবং ওয়াইসী প্রেমে নিমগ্ন থাকতেন। নবী পাক (সাঃ) তাঁদেরকে খুবই আদর করিতেন। রাসূল পাক (সাঃ) সাহাবাদের বলতেন “যান নিকট দুই জনের খাবার রয়েছে সে যেন একজন আসহাবুস সুফ্ফাকে তাঁর সহিত অর্ন্তভুক্ত করেন। 

প্রকৃত পক্ষে এই দলটি জীবিকার্জনের চিন্তা হতে মুক্ত অবস্থায় রাসূল (সাঃ) পাকের পাশে থেকে সর্বদা তাঁর শিক্ষা গ্রহণের প্রত্যাশি ছিলেন। এজন্য সাহাবীগণ তাঁদের খেদমত করা নিজেদের পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করতেন। তাসাউফের বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, সূফী ঐ সমস্ত ব্যক্তি যাঁরা নিজেদের ক্রিয়া-কর্মে আসহাবুস সুফ্ফার সদৃশ। দুনিয়া মুক্ত-রাসূল (সাঃ) প্রেমিক উত্তম চরিত্রের অধিকারী।  

হজরত সূফী শাহ্ আব্দুল আজিজ মহাদ্দেস দেহলভীর মতে মানুষের পক্ষে খোদার আক্রশ হইতে বাঁচার একটি মাত্র উপায় হল, সর্বপ্রকার দুর্নীতি মুক্ত জীবন যাপন করা এবং তা চরিত্র ও কর্মে প্রতিফলিত করা, সেবা ও ত্যাগই কর্ম সাফল্যের মূল ভিত্তি। শান্তির খোঁজে দিশেহারা আজ সারা পৃথিবী। কিন্তু আমি কে? এই বিরাট অথচ অতিক্ষুদ্র অতি পরিচিত প্রশ্নে উত্তর যেদিন মানবজাতি আবিস্কৃত করতে পারবে এবং কোন ফর্মুলা তৈরী করতে পারবে সেদিন পৃথিবীর মানুষ প্রকৃত শান্তি পাবার আশা করতে পারে। 

পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আঃ) হতে একটি মাত্র ধর্ম ইসলামের জন্ম। আর সেই একটি মাত্র ধর্মের একটি মাত্র কথা একটি মাত্র উপদেশ বিভিন্ন মহাপুরুষদের এবং অবতার তথা নবীদের নিজেকে চেনা। প্রত্যেক অবতার বা নবী যে ধর্ম প্রচার করে গেছেন, সেই ধর্মের নাম ইসলাম ধর্ম (শান্তির ধর্ম)। প্রেমের সামনে নিজের জীবন ও কত তুচ্ছ তার অবাক নমুনা হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) তাঁর দিওয়ানে নমুনা রেখে গেছেন স্মৃতির ইতিহাসে। 

ঊনবিংশ শতাব্দীতে সেই রকম একজন মহাপুরুষের আজকে যে আমার গবেষণার বিষয়। তিনি নিজেকে কেবলমাত্র HUJRA-র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, মানুষের হিতসাধনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। যেসব মানুষ দেশের স্বাধীনতার জন্য সারা জীবন অবহেলা ও বঞ্চনার স্বীকার হয়েছে তাঁদের জন্য তীব্রভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেই মহান সাধক হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মহান নেতা মহাত্মা সূফী কবি হজরত সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াসী (রহঃ) যার সম্পর্কে আলোচনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । যখন কোন সাধক লা ইল্লাহাতে ফানা হয়ে যায় তখন শুধু ইল্লাল্লাহ্ অবশিষ্ট থাকে। এই অবস্থায় উপনীত হয়ে হযরত বায়জীদ বলেছিলেন আমিই পবিত্র সত্তা। হযরত ফরিদউদ্দিন বলেছিলেন আমিই সে, হজরত হাল্লাজ বলেছিলেন, আমিই মহাসত্য। 

সাধকদের এসব উক্তি ও অর্ন্তনিহিত ভাব না বুঝে অনেকেই সাধকদের ভুল বুঝেছেন। কোন কিছুর অর্ন্তনিহিত মূলতত্ত্ব না বুঝে মুখে বলা কুফরী বলে হযরত খাজা বাবা বলেছেন, হযরত মুসা (আঃ) এর লাঠি সাপ হয়ে যাদুকরদের লাফালাফি রত দড়ি-লাঠিকে গিলে ফেলেছে। হজরত ইব্রাহিম (আঃ) অগ্নি কুন্ডে নিরাপদ ছিলেন। হযরত ঈসা (আঃ) আতুর ঘরে কথা বলেছেন এবং মৃতকে জীবিত করেছেন। এভাবে সকল নবীরই কিছু না কিছু মাজেজা ছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ্ আমন্ত্রণ করে সাক্ষাৎ করেছেন এমনটি শুধু হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর বেলায় ঘটেছে মিরাজ রজনীতে মহিমান্বিত আল্লাহ নিজের মহিমা ও সৃষ্টি নিগূড় রহস্যের সাথে তার হাবিবকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। বেহেশত দোজখ আরস কুরশী ইত্যাদি সমস্ত রহস্যে দ্বার সেদিন তিনি খুলে রেখে আপন বন্ধুকে দেখিয়েছিলেন। 

ভূমন্ডল, নভোমন্ডল ও ফেরেশতা কুলের সৃষ্টির মূল উপাদান হল নূরে মোহাম্মদী (সাঃ) সৃষ্টির মূল তত্ত্বই হল নূরে মোহাম্মদীকে সৃষ্টির কারণ। একজন প্রকৃত সূফীর কাছে বেহেস্তের আকর্ষনের চেয়ে ঈমানের পূর্ণতাই প্রধান লক্ষ্য। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তি (রহঃ) বলেছেন কলেমার মূলতত্ত্ব উপলব্ধি না করে মুখে বলা কুফরী। ত্যাগ না করে খোদা হাসিল করা যায় না। 

হযরত ইমাম গাজ্বালী বলেছেন, যিনি স্রষ্টা ও সৃষ্টির সাথে সমব্যবহার রাখতে পেরেছেন তিনিই প্রকৃত সূফী, পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে কোন বিষয়ে গভীরে প্রবেশ করে অনুসন্ধান চালিয়ে তার মূল উদঘাটনের চেষ্টা চালানই সূফীদের কর্তব্য। এ সকল সাধকগণকে সূফী সাধক বলা হয়। সূফীগণ মুসলিম বিশ্বে প্রথম সারির লোক। সূফী শব্দের অর্থ হল জ্ঞান বা প্রজ্ঞা।

বিশ্ব বিখ্যাত তাপস জুনুন মিসরি বলেছেন, যে জাগতিক লোভ লালসার উর্দ্ধে থেকে আল্লাহর আরাধনা উপাসনাকে জীবনে ব্রত করে নিয়েছেন তিনিই সূফী। জুনায়েদ বাগদাদী বলেছেন যিনি তার জীবনকে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন তিনিই সূফী। মহাত্মা মাতবুলী বলেছেন, যিনি তার অন্তঃকরণকে সৃষ্টির আবিলতা থেকে নিষ্কলুষ রেখেছেন কেবলমাাত্র আল্লাহ্ প্রাপ্তির আশায় তিনিই সূফী। হযরত বশর হাফি বলেছেন, আল্লাহর জিকির ছাড়া যিনি আত্মাকে পূত-পবিত্র রাখতে পেরেছেন তিনি সূফী। সহল বিন্ আব্দুল্লাহ তাসতারী বলেছেন যিনি সর্বদা সৎ বিভোর, স্বর্ণ মৃত্তিকা যার কাছে সমান, আল্লাহ্ প্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে জাগতিক লোভ লালসা থেকে দূরে থেকেছেন তিনিই সূফী। 

এইচ, মার্টেন গোল্ড জীহার প্রমুখের মতে বেদান্ত দর্শন অতি প্রাচীন, এদের কিছু সাধু সন্ন্যাসীরা সর্বদা চিন্তানুশীল থাকতেন। ভারতীয় মুসলমানরা এই চিন্তা ধারার সংস্পর্শে এসে বেদান্ত দর্শনে প্রভাবিত হয়ে সূফী দর্শন উদ্ভাবন করেছেন। এক কথায় মূলকথা হল, জগৎ সংসার বাস্তব মায়া মাত্র।

ইসলামী ইতিহাসে বলে একাদশ শতাব্দীতে সূফী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা  হযরত আবু ইসহাক আল কাজারুনি (মৃত ১০৩৪ খ্রীঃ ৪২৬ খ্রীঃ)। এসময়কার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আউলিয়া ও সূফী সাধক আলী ইবনে উসমান আলী হুজভিরি (রহঃ) (মৃঃ ১০৭৫ খ্রীঃ/৪৬৮ খ্রীঃ) রচিত সূফী দর্শনের উপর তাঁর গবেষণা মূলক কাশফুল মাহজুব গ্রন্থখানা ফারসী ভাষায় ২৫ অধ্যায়ে রচিত। 

খ্রীষ্ট্রীয় একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সূফীবাদের উপর চরম অত্যাচার নেমে আসে উমাইয়া, আব্বাসীয় রাজত্বে। এরা আহলে বায়াতের বংশধরদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করতো। ইমামে আজম আবু হানিফাকে কারাগারে বন্দী করে প্রত্যেক দিন ১০টা করে বেত্রাঘাত করতো। ইমামে শাফীকে কারাগারের বন্দী করে বেত্রাঘাতে জর্জরিত করত। এবং প্রত্যেক দিন তাঁর ১০ জন সচরীকে হত্যা করত। এরাই হযরত মুনসুর হাল্লাজকে হত্যা করেছিল। এক ধরনের ভাড়া করা আলেম এরা পুষতো। তাদের পরামর্শে এসব কাজ করতো। এদের পরামর্শেই জগৎ বিখ্যাত সাধক হযরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এবং জগৎ বিখ্যাত সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তি (রহঃ) কে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল।

অষ্টাদশ শতকে ওহাবী আন্দোলন সূফীবাদের ধ্যান ধারণাকে ধুলিষাৎ করার সর্বশেষ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এদের অত্যাচারের জর্জরিত হয়ে সূফীগণ আরবের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। আবার হালান্ড খাঁন ও চেঙ্গিস খাঁনের অত্যাচারে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করায় সূফীগণ আরব অঞ্চল ত্যাগ করারও একটা বড় কারণ। এই সময় তৎকালীন বহু সূফীগণ ভারতে (হিন্দুস্থানে) চলে এসেছিল। বর্তমান (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্থান)।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে আরব বংশদ্ভূত মুহাম্মদ বিনে আব্দুল ওহাব নজদী (মৃ: ১৭৮৭ খ্রী:/১২০২ হিজরী) ব্রিটিশ মদদ পুষ্ট হয়ে ওহাবী মতবাদ প্রচার শুরু করেন। মূলত আব্দুল ওহাবের দীক্ষা গুরু ছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার হামফ্লে, হামফ্লেজ ডায়রী নামক গ্রন্থ পড়লে দেখা যায় হেন কোন ইসলাম বিরোধী অন্যায় কাজ নেই যা ইবনে আব্দুল ওহাবী করেনি। পবিত্র কোরআনের ভুল ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে, নবী রাসুলদের বিরুদ্ধে কথা বলা, আউলিয়াদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা, তাদের সকল মাজার নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, আহলে বায়াতের সমাধি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, মাজহাবের ইমামগণ সম্পর্কে কটুক্তি করা, সাহাবীদের জ্ঞান গরিমা অস্বীকার করা ইত্যাদি কোন অনৈতিক কাজ ওহাবী আন্দোলন থেকে বাদ পড়েনি।

বিশ্ব বিখ্যাত সূফী সাধক জালাল উদ্দিন রুমী (রহঃ) (মৃ: ১২৭৩ খ্রী:/৬৭২ হি:) আবির্ভূত হন। প্রথম জীবনে গোড়া শরিয়তপন্থী ছিলেন। তাঁর পীর হযরত শামসে তাব্রিজের সংম্পর্শে আসার (১২৪৪ খ্রী:/৬৪২ হি:) পরে তাঁর জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে । চুর্তুদশ শতাব্দীতে খাজা নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (মৃ: ১৩৭৩ খ্রী:/৭২৫ হি:) দিল্লীতে তাসাউফের প্রচার করেন তিনি বাবা ফরিদ উদ্দিন গঞ্জে সাকারের মুরিদ ছিলেন। তৎকালীন আলেমদের সাথে বহুবার তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের পরাস্ত করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘রাহাতুল কুলুব’ তাসাউফের একটা বিখ্যাত গ্রন্থ।   

নবম ও দশম শতাব্দীতে দেখা যায় আমরা যে, ১২ ইমামে বিশ্বাসী এরা সকলেই হযরত সূফী ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর বংশে পূর্ব পূরুষ। সনদ নামায় আমরা দেখতে পাই ইমাম মুসা কাজিম (মৃ: ৭৯৯ খ্রি: /১৮৩ হি:) ইমাম আলী রেজা (মৃ: ৮১৮ খ্রী: /২০৩ হি:) ইমাম আলী তর্কী (মৃ: ৮৩৫ খ্রী:) ইমাম জাফর সাদিক ইত্যাদি।

হযরত আবু জর গিফারী (রহঃ) রাসূলের একজন গভীর সহচর্য পাওয়া সাহাবী, তিনি মদিনায় তাসাউফ প্রচার করতেন। হযরত ওমরের রাজত্বকালে তিনি সিরিয়া চলে যান। হযরত ওসমানের খেলাফত কালে উমাইয়াদের দুর্নীতি ও স্বজন প্রীতি ও দেশের সম্পদ লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া, খলিফা ওসমানকে নালিশ করেন তাঁর বিরুদ্ধে। পরবর্তিতে খলিফার নির্দেশে তাঁকে উটের পিঠে চড়িয়ে মদিনায় আনা হয় এবং শাস্তি হিসাবে মদিনা থেকে বহিস্কার করেন। তিনি পিতৃভূমি রাবাযাতে চলে যান, তিনি সেখানে দারুন অন্ন কষ্টে পড়েন। অন্ন কষ্ট সইতে না পেরে একদিন একমাত্র জীবিত মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রাবাযাত ত্যাগ করে অন্নের সন্ধানে যাচ্ছিলেন। ক্ষুধার জ্বালায় তিনি মাটিতে শুয়ে পড়েন এবং তিনি তাঁর মেয়েকে বললেন, আমি আর বাঁচব না, আল্লাহর রাসূল বলেছেন ইরাকের লোকেরা আমাকে দাফন করবে। মা চিন্তা করো না আমার মৃত্যু হলে চাদর দিয়ে আমাকে ঢেকে দিয়ে বসে থাকবে। এখানে হযরত আবু জর ইন্তেকাল করলেন। কিছুক্ষণ পরে মালিক ইবনে হারিস আল আশ্তারের নেতৃত্বে চৌদ্দজনের একটি ইরাকী কাফেলা উপস্থিত হলো। তাঁরা হযরত আবু জর গিফারী (রহঃ) মেয়ের মুখে নিদারুন কাহিনী শুনে সবাই শোকে বিচলিত হইলেন। তাঁরা যাত্রা স্থগিত রেখে নিজেদের অর্থ দিয়ে হযরত আবু জর গিফারী (রহঃ) কাফনের ব্যবস্থা করে দাফন করলো। হিজরী ৩২ সনের জিলহজ্ব মাসে হযরত আবু জর জিফারী (রহঃ) মৃত্যু বরণ করেন।  

Additional information