ওয়াইসী নেসবত লাভ

ওয়াইসী নেসবত লাভ

শুধু মানুষ নয় জীনকুলও মর্তের মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে লাখে লাখে হযরত সূফী ফতেহ আলী ওয়াইসী ক্বিবলার (রহঃ) মুরিদ হইতে লাগিল। তাঁহার ইনসান মুরিদ অসংখ্য ছিলেন যদিও সকলের নাম পাওয়া যায় না। তেমনি তাঁহার সংখ্যাতীত জীন মুরিদও ছিল।

তাঁহার হেদায়েতে প্রতিটি নগর, বন্দর ও পল্লীর প্রতিটি কুঠীর তাওহিদের নূরে, শরিয়তের সূর্য্য, মারেফতের চন্দ্রালোকে আলোকিত হইল। অখন্ড সর্বভারত, বলখ, বদখশান, খোরাসান ও পবিত্র মদিনা ভূমির প্রসিদ্ধ আলেম ওলামাগণও তাঁহার নিকট মুরিদ হইয়া প্রকৃত ও প্রখ্যাত ওলী আল্লাহ্ হইয়াছিলেন। সেকালের আমীর হইতে সাধারণ মানুষ সকলেই সম উল্লাসে, চরম আগ্রহে, বিপুল ভাবে তাঁহার হস্তে বয়েত হইয়াছিলেন।

তিনি অতি উচ্চস্তরের আলেম ও অলীআল্লাহ্ ছিলেন। তিনি হযরত নবী করিম পাকের (দঃ) ও পবিত্র আহলে বায়েতগণের ও হযরত গওসুল আলম পাকের (রহঃ) অসীম প্রেমিক পাগল ছিলেন। যাঁহার প্রতি তিনি নুরানী পলকপাত করিতেন মূহুর্তেই তিনি কামেলে মোকাম্মেল আরেফ হইয়া যাইতেন। কাদেরী চিশতী, নকশেবন্দী ও মোজাদ্দেদী চার ত্বরিকাতেই তিনি সকলকে শিক্ষা দীক্ষা দান করিতেন। তিনি তাঁহার বহু মুরিদকে দয়া পরবশ হইয়া হযরত নবী ক্বেবলার (দঃ) জিয়ারত লাভ করাইয়া ধন্য করিয়া দিয়াছিলেন।

দীন-দরিদ্র ও মাতৃপিতৃহীন এবং দূরবর্তী স্থলের মুরিদগণকে তিনি নিজ অর্থব্যায়ে আশ্রয়, আহার ও পরিচ্ছদ দিয়া পার্থিব ও মারেফাত বিদ্যাশিক্ষা দান করিতেন। সেকালে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ কামেলে মোকাম্মেল কুতবুল আলম অলীআল্লাহ্ ও মহান সুপ্রসিদ্ধ আলেম হইয়াও অতি সাধারণ অবস্থায় সাধারণ লোকের মত দিনাতিপাত করিতেন। মির্জাপুর ষ্ট্রীটের ‘খানকা শরীফে’ অবস্থান কালেই তিনি সর্বসাধারণকে তাসাউফের পথে আহবান করিয়া মুরিদ করিতে আরম্ভ করেন। বেগবাগান রো-এর খানকা শরীফে ও ওলীউল্লা লেনের খানকা শরীফে এবং পুনাশী গ্রামের খানকা শরীফে থাকাকালে তিনি বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত অশিক্ষিত ধনী দরিদ্র সকলকে মুরিদ করিয়াছিলেন। এই সময় তাঁহার অনেক মুরিদ কালের প্রসিদ্ধ আলেম ও প্রখ্যাত দরবেশে পরিণত হইয়াছিলেন।

দিনের চাকুরী শেষে তিনি প্রত্যেক রাত্রে মসজিদে ও খানকাতে মুরিদগণকে তালিম ও তাওয়াজ্জুহ দান করিতেন এবং স্বয়ং সারা রজনীব্যাপী কোরআন পাঠ, নফল নামাজ ও দোয়া দরুদ পাঠ এবং মোরাকাবা মোশাহাদায় অতিবাহিত করিতেন। মসজিদে অবস্থান করিয়া সকলকে মুরিদ করিতেন ও সকলকে হেদায়েত মাসলা মাসায়েলের উত্তর ও ফতয়া দান করিতেন।

তাঁহার ত্বরিকা ‘ওয়াইসীয়া’ নামে অভিহিত। উক্ত ত্বরিকা বর্তমানে শুধু বাংলা আসাম ও বিহারে না ভারতবর্ষ সহ সমগ্র পৃথিবীতে প্রচলিত। বিপুল সংখ্যক মানুষ উক্ত ত্বরিকার মাধ্যমেই আল্লাহ্ পাক ও রাসূল পাকের (দঃ) প্রেম অর্জন করিয়া আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্য লাভ করেন। তাঁহার প্রখ্যাত খলিফাগণের বংশধরগণ দেশে বিদেশে লক্ষ লক্ষ লোককে এই ওয়াইসীয়া ত্বরিকায় তালিম ও তাওয়াজ্জুহ বিতরণ করিতেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে এই ত্বরিকাই সমধিক প্রচলিত।

ওয়াইসীয়া ত্বরিকা সম্পূর্ণ রূপে দ্বীন-ইসলামী শরিয়তের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। ইহাতে বিন্দু মাত্রও অনৈসলামিক ও অলীক প্রভাব এবং মনগড়া কুদরতি নীতির লেশমাত্র দৃষ্ট হয় না। ইহাতে কেবল পবিত্র কোরআনের বিধান, পবিত্র হাদিসের নির্দেশ ও খোলাফায়ে রাশেদ্বীনের দ্বীনদারীর সরল, দৃঢ়, স্পষ্ট জীবন দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। ভক্তি, জ্ঞান ও কর্মের ত্রিমার্গগামি সাধনা একাধারে তাঁহার মধ্যে আসিয়া বিপুল ভাবে ভীড় করিয়াছিল।

তিনি অবশেষে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্ রাহে নিয়োজিত করিবার আকাঙ্খায় ও আল্লাহর বান্দাগণকে দ্বীনদারি মারেফত ও তসাউফ জ্ঞান বিস্তৃত আকারে শিক্ষা দিবার মানসে পলিটিক্যাল পেনসন অফিসের সুপারেনটেনডেন্ট সুউচ্চ পদটি স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। তখন তিনি আলীউল্লা লেনের বিবি সালেতের মসজিদ সংলগ্ন খানকাতে স্বপরিবারে বাস করিতেন।

ভীষণ বাত্যা-বিক্ষুদ্ধ সাগরে বৃক্ষের ক্ষুদ্র, একা, অসহায় তরুণীর অবস্থা ডাঙ্গার মানুষ, বুঝিতে পারে না, বুঝিতে জানে না। কিন্তু বিশ্ব-জগতের কান্ডারীর  স্নেহের চক্ষে কিছুই এড়ায় না। সে করুণায় আখিঁতে সমস্তই প্রতিফলিত হয়।

হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) একে একে পিতা, মাতা ও ভ্রাতাকে হারাইয়া, আশ্রয় ও সম্বলহীন হইয়া নিদারুণ দুর্বিপাকে পড়িয়াছিলেন। কিন্তু খোদাতালার অসীম অনুগ্রহ তাঁহার হাত ধরিয়া তাঁহাকে সব পাওয়ার মঞ্জিলে পৌঁছাইয়া দেয়।

তিনি সর্বপ্রথম কলিকাতার শহরতলা দমদম গোরাবাজারে (বর্তমান দমদম ক্যান্টনমেন্ট) চাকুরী প্রাপ্ত হইয়া কলিকাতা শিয়ালদহের নিকটবর্ত্তী মির্জাপুর ষ্ট্রীটের (বর্তমান সূর্য্যসেন স্ট্রীট) মির্জাপুর পার্কের (বর্তমান শ্রদ্ধানন্দ পার্ক) উত্তরদিকে মির্জাপুর ষ্ট্রীট ও আমহার্মট স্ট্রীটের সংযোগ স্থলের উপর একটি মাটকোঠাতে বসবাস করিতেন। অধুনা মাটকোঠাটি অবলুপ্ত। যতদূর জানা যায় হয় উক্ত মাটকোঠার স্থলের উপর বর্তমান ‘ইন্ডিয়া হোটেল’ সৌধটি নির্মিত হইয়াছে। পূর্বে এখানে বস্তিটি মুসলমান সমৃদ্ধ ছিল। তিনি উক্ত মাটকোঠাতে অবস্থান করিতেন এবং উক্ত খানকার পূর্বদিকে মির্জাপুর ষ্ট্রীটের সংলগ্ন বৈঠকখানা রোডের জনাব নবিবুল্লার মসজিদে নামাজ, যিকির-আসকার করিতেন।

এই খানকা শরীফে পুনরায় হযরত খাজা খেজর (আঃ) প্রকাশিত হইয়া বিশেষ স্নেহসহকারে তাঁহাকেেে এল্মে তাসাউফে পরিপূর্ণ তাওয়াজুসহ দান করেন।

তৎপর হযরত আলী করমআল্লা শেরেখোদা (রাজিঃ) হযরত ওসমান গণি যন্নুরায়েন (রাজিঃ) হযরত আবুবকর সিদ্দিকে আকবর (রাজিঃ) ও হজরত ওমর ফারুক ইসলাম কান্ডারী (রাজিঃ) আবির্ভূত হইয়া তাঁহাকে আপন আপন অমূল্য নিসবত ব্যক্তিগত ভাবে দান করিয়া যান।

অতঃপর হযরত মা ফাতেমা জোহরা (রাজিঃ) ও হযরত মা আয়েশা সিদ্দিক (রাজিঃ) তাঁহাকে নিজ নিজ পুতঃ নিসবত বিশেষ ভাবে বকশিশ দিয়া তাঁহাকে সৌভাগ্যবান করেন।

নবী করিম হুজুরের (দঃ) উপরোক্ত চারি খলিফা আসহাবগণ (রাজিঃ) ও হযরত মা ফাতেমা জোহরা (রাজিঃ) ও হযরত মা আয়েশা সিদ্দিক (রাজিঃ) তাঁহারা সারা জীবনে তাঁহার সমীপে বহুবার তশরিফ আনিয়াছিলেন।

অতঃপর নূর-নবী হযরত আহম্মদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা দূকূল কান্ডারী হুজুর (দঃ) তাঁহার তশরিফ আনয়ন করিয়া তাঁহাকে অসীম স্নেহ-সম্ভাষণে ‘নিজ-পুত্র’ ডাকিয়া, আপন পুত বক্ষে জড়াইয়া ব্যক্তিগত ভাব আপন পবিত্র ও মহার্ঘ নিসবত দান করিয়া উভয় জগতে মহাভাগ্যবান করেন। কিছু পরবর্তী সময়ে পুনঃ আবির্ভূত হইয়া এরশাদ ফরমান যে, যখনই তিনি ইচ্ছা করিবেন তখনই তিনি নিদ্রা ও জাগরণে তাঁহার জিয়ারত লাভ করিবেন। এই জন্য তদবধি তিনি ‘রাসূলেনোমা’ বলিয়া প্রসিদ্ধ লাভ করেন।

বাস্তবিকই তিনি অতি উচ্চাঙ্গের ‘রাসূলেনোমা’ দরবেশ ছিলেন। পলক মধ্যে তিনি তাঁহার বহু মুরিদের সঙ্গে হযরত রাসূল পাকের (দঃ) দর্শন ঘটাইয়া দিয়াছিলেন। তিনি হযরত রাসূল পাকের (দঃ) নিসবত প্রাপ্ত কালে তাঁহার কদমবুসি করিয়া তাঁহার পবিত্র রাঙা চরণ দুইটি নয়ন জলে ধোয়াইয়া দিয়াছিলেন।

হযরত মাওলানা সূফী খন্দকার আব্দুল হক মুর্শিদাবাদী (রহঃ) তাঁহার একজন বিখ্যাত মুরিদ ছিলেন। তিনি আপন পিতা হযরত খন্দকার মোহাম্মদ সাবেতকে (রহঃ) যে পত্র লিখিয়াছিলেন তাহা হইতে প্রকাশ হয় যে, হযরত সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বেবলার (রহঃ) হযরত নবী করিম পাকের (দঃ) নিকট হইতে উচ্চ সম্মান, নিসবত ও স্নেহপ্রাপ্ত হইয়া ওয়াইসী ত্বরিকার অধিকারী হইয়াছিলেন। এই ফার্সী পত্রখানির নকল বিস্তারিত ভাবে তাঁহার রচিত “দিওয়ানে ওয়াইসীতে” উদ্ধৃত আছে।

অনন্তর এই মাটকোঠার খানকাতেই একদা তিনি হযরত ঈমাম নোমান আবু হানিফার (রাজিঃ) নিকট হইতে রূহানীভাবে বায়াত হইয়া হানাফি ত্বরিকা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি হযরত ঈমাম সাহেবের নিকট হইতে ইসলামিক শরা শরিয়তের বিষয়ে সুগভীর জ্ঞনার্জ্ঞন করিয়াছিলেন এবং হযরত হানাফির ত্বরিকায় খেলাফত পাইয়াছিলেন। এখানেই তিনি অতঃপর হযরত ওয়ায়েস করণীর (রহঃ) কাছ হইতে তাঁহার নিসবত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তদানন্তিন এই খানকাতেই তিনি গাউসুল আযম হযরত সাইয়েদ আব্দুল কাদের জিলানী বাগদাদী (রহঃ), সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা গরীব নেওয়াজ মঈনউদ্দিন চিশতী সঞ্জরী আজমিরী (রহঃ), ঈমামুত-ত্বরিকত হযরত খাজা মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন নকশবন্দী নাজ্জারী বুখারী (রহঃ) এবং ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদ আল ফেসানী হযরত আবুবকর বদরুদ্দিন শায়খ্ আহমদ ফারুকী মুজাদ্দেদী সেরহিন্দী (রহঃ) এর নৈকট্য হইতে তাঁহাদের ব্যক্তিগত  স্নেহ ও পবিত্র নিসবত প্রাপ্ত হন এবং উপরোক্ত চার ত্বরিকায় বিশিষ্ট খেলাফত পদ অর্জন করেন।

সারা জীবনে তিনি বারবার উপরোক্ত সরদার পীর ক্বেবলাগণের দর্শন প্রাপ্ত হইয়া ধন্য হইয়াছিলেন।

হযরত বড় পীর সাইয়েদ আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর সহিত তাঁহার বিশেষ সুগভীর মুহব্বতের সম্বন্ধ ও নৈকট্য বিরাজমান ছিল। সর্বদাই তিনি তাঁহার দর্শন প্রাপ্ত হইতেন।

সমগ্র আহলে বয়েতগণের সহিত তাঁহার সীমাহীন গভীর প্রেমের সম্বন্ধও যোগাযোগ ছিল। রূহানী ধারায় তিনি তাঁহাদের প্রত্যেকের নিকট হইতে তাঁহাদের পবিত্র নিসবত বিশেষ ভাবে অর্জন করিয়াছিলেন।

তাঁহার সমগ্র জীবনে তিনি সর্বদা হযরত নবী পাকের (দঃ) জিয়ারত লাভ করিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন প্রথিতযশা ‘ফানাফির রাসূল’ ও রাসূলেনোমা’ দরবেশ। এই সমস্ত প্রেমের কথা তিনি নিজ রচিত বিখ্যাত ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ নামক মহাকাব্য গ্রন্থের প্রতিটি পাতায় অজস্র ধারায় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।

তিনি সমগ্র আসহাব (রাজিঃ) আহলে বায়াত (রাজিঃ), আউলিয়া (রাজিঃ) এবং হযরত রাসূল পাকের (দঃ) ও হযরত খাজা খেজের (আঃ) নিকট বায়াত হইয়া একে একে সকলের নিসবত পাইয়া ‘নিস্বতে-জামেয়ার’ অধিকারী হইয়াছিলেন। এইভাবে তাঁহার গুপ্ত (বাতেনী) দীক্ষা সমাপ্ত হয়।

Additional information