প্রকাশ্য বায়াত ও খেলাফত

প্রকাশ্য বায়াত ও খেলাফত

শিশু-চন্দ্র হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বা (রহঃ) এক, দুই করিয়া দিনে দিনে শরিয়ত-মারফৎ সূর্য্য হইতে জ্যোতি আকর্ষণ করিয়া ক্রমশঃ দীপ্তিমান হইতে লাগিলেন। আজ তাঁহার জীবন পূর্ণিমালগ্নে সমাকীর্ণ। ইতিপূর্বে খোদাতালার অপার অনুগ্রহে তিনি সমগ্র আউলিয়া, আসহাব, আহলে খাজা খেজরের (আঃ) এবং হযরত নূর নবীর (দঃ) হইতে মহামূল্য নিসবতগুলি প্রাপ্ত হইয়া তাসাউফের সুউচ্চ শিখর-রাজ্যে আরোহণ করিয়াছেন; সকলেই তাঁহাকে খেলাফত দান করিয়াছেন। এইরূপে তাঁহার বাতেনী (গুপ্ত) শিক্ষা পরিপূর্ণ হইয়াছে।

এক্ষণে তিনি প্রকাশ্য (জাহেরী) মুরিদ হইবার জন্য ও প্রকাশ্যভাবে যাবেতীয় নিসবত অর্জন করিবার মানসে হাজী, গাজী, হযরত শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ ক্বেবলার (রহঃ) শরণাপন্ন হইলেন। হযরত নূর মোহাম্মদ (রহঃ) ছিলেন তাঁহার ও তাঁহার পিতার নিকট আত্মীয়। তিনি হযরত নূর মোহাম্মদ ক্বিবলা কা’বার (রহঃ) পবিত্র হস্তে দীক্ষিত হইয়া তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন ও অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে কাদেরী, চিশ্তী, নকশবন্দি ও মুজদ্দেদী ত্বরিকায় প্রধান খেলাফত পদ অর্জন করেন। তাঁহার পীর ক্বেবলা সে সময় কলকাতায় অবস্থান করিতেছিলেন। হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) তখন কলিকাতা মির্জাপুর ষ্ট্রীটের খানকাতে থাকিয়া দমদম গোরাবাজারে চাকুরী করিতেন। প্রত্যহ এশার নামাজ সমাধা করিয়া তিনি তাঁহার পীর ক্বেবলার নিকটে উপস্থিত হইয়া তালিম, তাওয়াজ্জুহ ও তাহজ্জুদ নামাজ অন্তে পুনরায় সেই রাত্রি মধ্যেই আপন খানকাতে প্রত্যাবর্তন করিতেন।

তাঁহার পীর ক্বেবলা তাঁহাকে গভীর স্নেহ করিতেন ও ‘আমার ফতেহ্’ বলিয়া ডাকাডাকি করিতেন। তিনিও তাঁহার পীর ক্বেবলাকে অত্যন্ত ভক্তিও চরম মহব্বত করিতেন। যখন সময় ও সুযোগ পাইতেন তাঁহার পীর ক্বেবলার নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার সেবা-কার্য্যে তম্ময় হইয়া যাইতেন। পীরের সেবা করা আবশ্য কর্তব্য জ্ঞান করিয়া এই কার্য্যকে সৌভাগ্যের বিষয় বিবেচনা করিতেন।

তিনি কখনও আপন পীরের পবিত্র দেহ অথবা প্রতিবিম্বের উপর নিজ প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত করেন নাই। কখনও তাঁহার পীর ক্বেবলার পবিত্র ছায়া পদদলিত করেন নাই এবং পীরের অগ্রে গমন করেন নাই। ভুলক্রমেও পীরের স্বর হইতে নিজ স্বর উচ্চে বর্দ্ধিত করেন নাই। পীরের আসন হইতে উচ্চাসনে তিনি উপবেশন করেন নাই। যখন আপন পীরের নৈকট্যে অবস্থান করিতেন তখন পীরের অজুর পানি সরবরাহ্ করা ও মিসওয়াক আগাইয়া দেওয়া তাঁহার বিশিষ্ট অভ্যাস ছিল। পীর যে সকল খাদ্য পছন্দ করিতেন তাহা সরবরাহ করিয়া তিনি আনন্দিত হইতেন। হযরত সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) এর শিষ্যবৃন্দের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ খলিফা ও মুরিদ।

হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) এর পূর্বপুরুষ হযরত বখতিয়ার কুতুবুল-আলাম গজনীর অধিবাসী ছিলেন। তিনি তাঁহার মাতুলের অত্যাচারে পুত্র ফিরোজ শাহ্, কন্যা-মায়মুনা, স্ত্রী এবং কিছু আত্মীয়-স্বজনসহ দিল্লীতে হিজরত করে রাজ দরবারে আশ্রয় লাভ করেন। পিতার পরলোক গমনের পর নানা কারণে হযরত ফিরোজ শাহ্ দিল্লী পরিত্যাগ করিয়া ভগ্নি মায়মুনা ও আত্মীয়-পরিজন সহ বর্তমান বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার ছান্দিয়া গ্রামে আসিয়া বসবাস করেন। বাদশা ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি সুজা সহিত হযরত মায়মুনার (রহঃ) বিবাহক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এই হযরত মায়মুনার (রহঃ) বংশধর মোহাম্মদ পানাহ্ (রহঃ) হইতেছেন হযরত নূর মোহাম্মদের (রহঃ) পিতা। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে বালাকোর্টের ঐতিহাসিক শিখ-যুদ্ধে নিজে পীরের সহিত গমন করিয়া উক্ত যুদ্ধে মোজাহেদ বাহিনীর অগ্রনায়ক হন। পীরের শাহাদত বরণের পর তিনি কলিকাতায় অবস্থান করিতে থাকেন। তিনি অতি উচ্চস্তরের দরবেশ ও অতি প্রসিদ্ধ মাওলানা ছিলেন। তাঁহার বহু মুরিদ ছিল। বহু সংখ্যক জীনও তাঁহার শিষ্যত্ব বরণ করিয়াছিল। তিনি ও তাঁহার সর্বপ্রধান ও প্রিয়তম শিষ্য হযরত সাইয়েদ শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বেলার (রহঃ) ন্যায় ‘রাসূলে নোমা” ও কারামত সম্পন্ন আউলিয়া ছিলেন। তদানিন্তন ব্রিটিশ সরকার তাঁহাকে বন্দী করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াও নিষ্ফল হইয়াছিল। তিনি অতঃপর নিরিবিলিতে ধর্ম-কর্ম করিবার মানসে নিজালয় মালিয়াশ গ্রামে আসিয়া স্থায়ীভাবে বসবাস করিতে থাকেন। এইখানেই হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) অলৌকিক ক্ষমতা বলে কলিকাতা হইতে রজনীকালে যাতায়াত করিয়া তাঁহার হস্তে বায়াত হইয়াছিলেন। হযরত নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) চিরকুমার ছিলেন। তিনি তাঁহার জনৈক আত্মীয় পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ্কে (রহঃ) পোষ্য পুত্ররূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। ১২৬৫ বাংলা সাল মোতাবেক ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে হযরত নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) মালিয়াশ গ্রামে পরলোক গমন করেন। তাঁহার পবিত্র মাজার উক্ত মালিয়াশ গ্রামে বিদ্যমান আছে। তিনি জীবদ্দশায় মালিয়াশ গ্রামে আপন খানকার পার্শ্বে একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করিয়া গিয়াছেন।

Additional information