পরলোক গমন

ওয়াইসী ক্বেবলা কা’বা র (রহঃ) পরলোক গমনঃ

মহা পবিত্র কোরআনের বাণী, “প্রত্যেক মানব-দানব, জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গ, পশু-পাখী সকলেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিবে”। জগতের নিয়মানুযায়ী একে একে সকলকেই মহিমময় সর্ব্বশক্তিশালী আল্লাহ্তালার কাছে ফিরিয়া যাইতে হইবে। আজ যে আছে আগামীকাল তাহার অস্তিত্ব থাকিবে না। আজ যে বিহঙ্গ গান গাহিল, কাল সে আর গাহিবে না। তাহার কন্ঠ-বাণী চিরকালের জন্য নীরব হইয়া যাইবে। আজ প্রভাতে যে ফুল ফুটিল সন্ধ্যায় সে ঝরিয়া পড়িবে; আগামী প্রভাতের অপেক্ষায় থাকিবার অবসর তাহার নাই। ইহাই সংসারের শাশ্বত, সত্য, অমোঘ নীতি।

মানুষ মরণশীল। জীবমাত্রই মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ইহা চিরন্তন সত্য গোলাপ, বেলী, চামেলি, হেনা প্রভৃতি সব পুষ্প তাদের মাধুর্য উজাড় করে দেন বিশ্বময়, তারপর কিছু সময় অতিবাহিত হলে সময়ের গর্ভে সব ফুল শুষ্ক হয়ে যায়। কোনো কিছুই চিরন্তন নয়, সেইরূপ কত সাধক, সূফী, কবি পন্ডিত এবং বুদ্ধিজীবি এই বিশ্বে আবির্ভূত হন। তারপর তাদের কাজ মহান কর্ম সম্পাদন করে পরলোকে পাড়ি দেন। সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়ে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। সূর্যের উপস্থিতি পৃথিবীকে যেরূপ পূর্ণ সজীবতা দান করে সেইরূপ কিছু কিছু প্রথত যশা শিশু মাতৃক্রোড়ে জন্মলাভের পর বিশ্বকে জ্ঞানের আলো দান করে কিছু কাল ব্যাপী। তারপর তাঁহারা চিরকালের জন্য পরলোকে যাত্রা করেন।

হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বা (রহঃ) বাংলা সন ১২৯৩ সালের আশ্বিন মাসে এক সন্ধায় মাগরিবের নামাজ শেষে বিবি সালেতের মসজিদে প্রাণের সমস্ত মুরিদগণের সমক্ষে প্রকাশ করেন যে, ‘প্রত্যেক মানুষকে মরণের স্বাদ গ্রহণ করিতেই হইবে। আমার মৃত্যু পর কেহ শোকে অধীর হইওনা। সকলে পবিত্র কোরআন হাদিসকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করিবে। অল্প খাইবে, অল্প বাক্যলাপ করিবে, পরোপকার করিবে। নামাজ ও রোজা ঠিক মত পালন করিবে; যাকাত দিবে। সৎ পথের উপার্জন দ্বারা আহার করিবে, দ্বীন ইসলামি শিক্ষা লাভ করিবে। আমার ত্বরিকায় অটলভাবে অবস্থান করিবে ও আমার কন্যাকে তাজিম করিবে, কেন না তিনি “গুপ্তমতি”।’ অতঃপর বলেন, “আমি শীঘ্রই তোমাদের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিব।” তৎপর সকলকে তালিম-তাওয়াজ্জুহ দেন। তাঁহার বিদায় গ্রহনের সংবাদ শ্রবণে প্রিয় মুরিদগণ বেদনায় শিহরিয়া উঠেন।

একদা তাঁহার পূণ্যময়ী বিদূষী কন্যা হযরত সাইয়েদা জোহরা খাতুনকে (রহঃ) তাঁহার জীবন-সন্ধ্যা যে ঘনাইয়া আসিতেছে তাহা জানাইয়া ধৈর্য্য ধারণ করিতে বলেন ও কতিপয় উপদেশ দান করিয়া খাসভাবে তাঁহাকে তাওয়াজ্জুহ প্রদান করেন। তৎপর পরম স্নেহে তাঁহার কন্যার অছিলায় ‘নিসতে-জামেয়ার’ গ্রহণ করিয়া তাঁহার কন্যার মর্যাদা যে কত উচ্চে তাহা সমগ্র মুরিদগণকে দর্শন করাই দেন। তাঁহার অন্তধীনের পরে সকলকে তাঁহার কন্যা অছিলা ধরিয়া ‘নিসতে-জামেয়ার’ ফয়েজ অর্জন করিতে আদেশ দান করেন। অতঃপর তিনি কন্যাকে তাঁহার ত্বরিকা শক্তরূপে ধারণ করিয়া থাকিতে বলেন।

এক দিবসে তিনি তাঁহার পুত্র হযরত সাইয়েদ গোলাম মোস্তফা আলীকে (রহঃ) তাঁহার সত্তর বিদায় গ্রহণের সংবাদ জানাইয়া ধৈর্য্য ধরিতে বলিয়া তাঁহার ত্বরিকা দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করিতে বলেন।

আর একদিন তিনি তাঁহার পূণ্যবতী পত্নীকে তাঁহার অতি শীঘ্র ইহ জগৎ হইতে বিদায়ের বার্তা ব্যক্ত করিয়া সবর করিতে বলেন ও তাঁহার ত্বরিকা-রজ্জু সুদৃঢ়রূপে অবলম্বন করিতে নির্দেশ দান করেন। এই সমস্ত ঘটনা ওলিউল্লা লেনে বিবি সালেতের মসজিদ সংলগ্ন কুঠিতে সম্পন্ন হইয়াছিল। আজীবন ও মৃত্যু-রোগের পূর্ব পর্যন্ত তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন।

হুগলী জেলার তারকেশ্বর রেল-লাইনের নসিবপুর স্টেশনের নিকটবর্তী মোল্লাসিমলা গ্রাম হইতে তাঁহার জনৈক মোল্লা মুরিদ, ওলিউল্লা লেনের কুঠিতে আসিয়া দাওয়াত গ্রহণ করিবার জন্য একান্ত আগ্রহ সহকারে বিনীত নিবেদন করেন। তিনি মোল্লাসিমলা গ্রামে যাইয়া মুরিদের দাওয়াত গ্রহণ করিতে বিশেষভাবে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেও, মুরিদের কাতর পীড়াপীড়িতে সম্মত হইয়া বাংলা ১২৯৩ সালের অগ্রহায়ণ মাসের ১৯শে তারিখ শনিবার সন্ধ্যা-রাত্রে তাঁহার প্রখ্যাত অত্যতম প্রধান মুরিদ হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহম্মদ আলী সুরেশ্বরী (রহঃ) হযরত সূফী আবু বকর সিদ্দিকীকে (রহঃ) সহ অন্যান্য ভক্তদের সঙ্গে করিয়া উক্ত গ্রামে মোল্লা মুরিদের গৃহে উপস্থিত হন। নাস্তা খাওয়ায় পর তিনি উক্ত গ্রামে হযরত হাসান হালবীর (রহঃ) মাজার শরীফ জিয়ারত করেন। তৎপর কতিপয় মুরিদসহ উক্ত গ্রামের জমিদার ও তাঁহার মুরিদ জনাব খোন্দকার আব্দুর রহমান সাহেবের বাড়ীতে অবস্থান করেন। এই সময় হইতে তাঁহার শারীরিক অবস্থা হঠাৎ খারাপ হইয়া পড়ে। রাত্রের আহার উক্ত মোল্লা মুরিদের বাড়ী হইতে আনিত হয়। তিনি তাঁহা আহার করিয়া বিশ্রাম করিতে থাকেন। রাত্রে তাহাজ্জুদ নামাজ অন্তে তিনি তাঁহার মুরিদগণের সমক্ষে প্রকাশ হন।

বাবা ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) বলেন তন্ ফিরের ফায়েজ আসছে শীঘ্রই আমি দ্বারে ফানা থেকে দ্বারে বাকায় পদার্পণ করব। আমাকে অতি শীঘ্যই কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে চল। ট্রেন যখন হাওড়া স্টেশনে পৌঁছাবে ঠিক সেই সময় ১৮৮৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাংলা ১২৯৩ সালের ২০ই অগ্রহায়ণ বিকাল ৪টায় দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তারপর হাওড়া স্টেশন থেকে পুলিশ পিকেট করে কলকাতা তালতলায় বিবি সালেটের মসজিদে আনা হয়।

Additional information