ওয়াইসী নামের অন্তর্নিহিত রহস্য

ওয়াইসী নামের অন্তর্নিহিত রহস্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ সাহেব মন্তব্য করেছেন, ওয়াইসী শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ বৎস যিনি আল্লাহ্’র ওপর নির্ভরশীল (মুখাপেক্ষী) উদিষ্ট্য।

বিশ্ববন্দিত কবি হযরত রুমি (রহঃ), হযরত জামি (রহঃ), হযরত শেখ সাদি (রহঃ), হযরত ফেরদৌসী (রহঃ) ভিন্ন ভিন্ন নামে কবিতা রচনা করেছেন। যেমন দিওয়ানে হযরত জালালউদ্দিন রুমি ‘মসনবি’ দিওয়ানে ফেরদৌসীর ‘দেওয়ানে হাফিজ’ নাম দিয়েছেন। শেখ সাদি’র দেওয়ানে নাম ‘গুলিস্তা বুস্তা’। কিন্ত হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী’র অলৌকিক দেওয়ানের নাম অন্যদের দেওয়ানে নাম অপেক্ষা ভিন্নতর। এই দেওয়ানের মূল বিষয় হল পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) প্রতি প্রগাঢ় প্রেম। দিওয়ানে ওয়াইসী তাঁহার দিওয়ানের নাম। তিনি সরাসরি কাব্যিক নামের সাথে তাঁহার দিওয়ানের নাম রেখেছেন। এটাও একটা রহস্য!

তিনি একটি মাত্র বিষয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর সেই বস্তু হল পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি প্রেমভক্তি। তিনি সকল বিষয় পরিহার করে কেবলমাত্র পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি প্রগাঢ় আসক্তির ওপর মন সন্নিবেশ করলেন কেন?

প্রথম যে বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাহলো কেন তিনি সকল বিষয় পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র হুজুর মোহাম্মদ (সাঃ) এর করুণাকেই জীবনের আদর্শ রূপে গ্রহণ করলেন। আর তার মধ্যেই বা কি অন্তর্নিহিত আছে? পবিত্র ‘কোরআন শরীফ’ এর সূরা নিসার ৬৯ আয়াতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দেখা যায় যেখানে উল্লেখ আছে, যে কোন ব্যক্তি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁহার পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদের মহব্বাত বা আনুগত্য করেন তারা জান্নাতে তাঁদের সঙ্গী হবেন। যাঁরা পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদের (সাঃ) প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন আল্লাহ তাঁদের প্রতি অত্যন্ত খুশী হন।

পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদের (সাঃ) বহু সাহাবী যখন হুজুর (সাঃ) কে প্রশ্ন করেন। আমরা আমাদের অন্তরের অন্তরস্থল থেকে মনে প্রাণ তাঁকে ভালোবাসি। তাঁকে ব্যতিরেকে আমরা এই জগতে বা পরলোকে এক মূহুর্তও থাকতে পারি না। দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পরে, কারণ বেহেস্তে তো নবীদের স্থান আলাদা। তাঁকে বিনা আমরা থাকব কিভাবে? তখন তিনি নীরব। নিরুত্তর। সর্বশক্তিমান আল্লাহ’র নির্দেশ ব্যতীত কোনো জবাব দেওয়া তাঁহার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কয়েক দিবস অতিক্রান্ত হলে সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ জিব্রাইল মারফৎ মদিনা শরীফে পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদকে উত্তর দেন (সূরা, নিসা: ৬৯নং আয়াত) নবী পাকের আশেকদের বেহেস্তে নবীদের সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি।

আধ্যাত্মিক বা রূহানী জগতে ওয়াইসীয়া নামে অতিশয় মর্যদা পূর্ণ ও প্রবলতম আধ্যাত্মিক রূহানী শক্তি সম্পন্ন খোদা প্রাপ্তির একটি অতি উচ্চ ত্বরিকা রহিয়াছে। অতি অল্প সংখ্যক আউলিয়া ইহা লাভ করিয়াছেন। কেহ স্বেচ্ছায়, আকাঙ্খা বা প্রার্থনা করিয়া ইহা লাভ করিতে পারে না। ইহা শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার এনায়েত, ফজল ও রহমতের দ্বারা লাভ করা যায়। সম্পূর্ণ রূপেই তাহা আজলী ও তকদীরী রূহানী সম্পর্ক। রাসূলেনোমা হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) হযরত ওয়ায়েস করণী (রহঃ) হইতে রূহানী দীক্ষা ও শক্তি লাভ করিয়া ওয়াইসীয়া ত্বরিকার ফয়েজ, নেসবত ও খেলাফত লাভ করিয়াছিলেন।

ইহা ব্যতীত তিনি মাসুমিয়া ও সোহরাওয়ার্দীয়া ত্বরিকার ফয়েজ নেসবত ও খেলাফত লাভ করিয়াছেন। তিনি সর্ব্বমোট সাতটি ত্বরিকা অর্থাৎ কাদেরিয়া, চিশতিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, নকশবন্দীয়া, ওয়াইসীয়া, মাসুমিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া ত্বরিকার খেলাফত লাভ করিয়াছেন এবং এই সাতটি ত্বরিকাতেই তিনি মুরিদ করিতেন। তাঁহাকে ‘ফানা ফির-রাসূল’ বা আনন্দ কান্দ রাসূল বলা হত।

কীট-পতঙ্গ যেমন মরিয়া আলোক শিখার পানে ধাবিত হয়, তেমনি বাংলা, বিহার, উড়িশ্যা, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব, ভূপাল এমন কি সুদূর বলখ, বদাখশান, খোরাশান ও মদিনা শরীফ হইতে সত্য সন্ধানীগণ সমাগম হইয়া ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ পাওয়ার আশায় তাঁহার পবিত্র হাতে বায়াত হইতে লাগিল।

তাঁহার পঁয়ত্রিশ জন মুরিদ খলিফার প্রত্যেককেই রাসূল করিম (সাঃ) এর প্রেম, ভালবাসা, আনুগত্য ও আধ্যাত্মিক জগতের পূর্ণ শিক্ষা-দীক্ষা দান করিয়া পরিপূর্ণ ভাবে কামেল পীরের মর্যাদা দান করিয়াছেন। তাঁহার পয়ঁত্রিশ জন বিশিষ্ট মুরদ ও খলিফার নাম পবিত্র ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ কিতাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। তিনি যদি সূর্য্য হন তাঁহার ৩৫ জন খলিফা এক একটি তারকা। দিওয়ানে ওয়াইসী কাব্যগ্রন্থটি অতি উচ্চাঙ্গের মৌলিক এই মহাকাব্যে হযরত রাসূলে করিম (সাঃ) এর এশকে মধুর প্রেম পূর্ণ, ঝংকার সম্পন্ন আধ্যাত্মিক লহরীময় গজল ও কাসিদা রহিয়াছে। মহাকাব্যটি রচনা করিয়া তিনি ফার্সী মহাকবি হিসাবে সমগ্র বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছেন। তাসাউফ পন্থী আশেকে রাসূল (সাঃ) গণের জন্য এই কিতাবখানি মহামূল্যবান ও অত্যন্ত জরুরী।

কুতুবুল এরশাদ রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর পবিত্র ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ মহাকাব্যে একটা বিষয় পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে যে, নবী করিম (সাঃ) এর প্রতি প্রেম ভালবাসাই আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন ও নাজাত পাওয়ার একমাত্র পথ। তিনি তাঁহার ভক্ত অনুসারীগণকে সর্ব্বদা নবী করিম (সাঃ) এর প্রেম ভালবাসা ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দিতেন।
নবী করিম (সাঃ) এর প্রতি প্রেম ও ভালবাসাই যে রাহে মুস্তাকিম অর্জনের অন্যতম উপায় তাহা তিনি ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’র মধ্যে এইভাবে বলিয়াছেন,

“চু রাহে মোস্তাকিম বজুয সুন্নাতে তু নিস্ত
‘ওয়াইসী’ ব-জাঁ গুযিদাহ রাহে মোস্তাকিম রা।’

অর্থাৎ হে রাসূল (সাঃ) আপনার সুন্নতের অনুসরণ ব্যতীত যখন রাহে মুস্তাকিম অর্জন করা সম্ভবপর নহে, তখন ওয়াইসী’র জীবন দিয়া হইলেও সুন্নতের অনুগামী হইয়া রাহে মুস্তাকিম অর্জন করিবে।

আবার অন্যত্র তিনি বলিয়াছেন,

“আগর আঁ শাহে খুবানম নহদৃ বর চশমে মন পারা
বখাকে পায়ে উ বখশম মায়ান দুনিয়া ও উকবা রা।”

অর্থাৎ যদি সেই রূপেররাজা (রাসূল পাক সাঃ) আমরা দু’নয়নের উপর তাঁহার কদম মোবারকদ্বয় (কিছু সময়ের জন্য হইলেও) রাখিতেন, তাহা হইলে তাঁহার মোবারক পদধূলির জন্য আমি আমার দুনিয়া ও আখেরাত বিলাইয়া দিতাম। রাসুল পাক সাঃ প্রতি ভালবাসার ইহা এক অনবদ্য নিদর্শন। যাহার শিক্ষা তিনি অহরহ প্রদান করিতেন।

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) নিজ আয়ের এক তৃতীয়াংশ সংসার পরিচালনার জন্য ব্যয় করিতেন। বাকি টাকা অসহায় নিরন্ন, দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করিতেন। তিনি খুব সামান্য আহার করিতেন শুধু জীবন রক্ষার নিমিত্তে যতটুকু প্রয়োজন। রসনা বিলাসের নিমিত্তে কখনো আহার করিতেন না।

হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) স্বীয় পীর মোর্শেদের প্রতি অতিশয় উচ্চ মর্যাদা ও শ্রদ্ধা পোষণ করতে গিয়া তিনি ছফিনায়ে সফর কিতাবে হযরত ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বার নামের সাথে নিন্মোক্ত লকব সমূহ ব্যবহার করিয়াছেন,

“শাহান শাহে আলমে হকিকত গৌহরে এক্তা মদনে মারেফৎ রশিদে রাশেদ ও কোতবে এরশাদ হযরত মাওলানা মোর্শেদুনা শাহে ফতেহ্ আলী সাহেব মাগফুর (রহঃ)।” তিনি একাগ্রচিত্তে পড়াশুনায় নিমগ্ন থাকিয়া দিনাতিপাত করিতেছিলেন। মাদ্রাসা ও ছাত্রাবাস পরস্পর সন্নিকটে অবস্থিত। মধ্যস্থলে একটি মাত্র রাস্তা পূর্ব-পশ্চিমে বিলম্বিত। এই রাস্তার দক্ষিণ পার্শ্বে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা এবং উত্তর পার্শ্বে ছাত্রাবাস ও অধ্যক্ষের বাসভবন। রাস্তার এপার এবং ওপার যাতায়াতের মধ্যে তাঁহার পড়াশোনার দিনগুলি একে একে স্বাচ্ছন্দ্যে অতিবাহিত হইতেছিল।

আধ্যাত্মিক সাহিত্য রত্ন হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) সেই অলৌকিক ক্ষমতাকে স্বরচিত ‘নূরেহক্ব গঞ্জেনূর’ কিতাবের ‘পীর মুরিদ’ অধ্যায়ে এইভাবে বর্ণনা করিয়াছেন-

“জবরুত বাগানে সাহা আছিলেন অলী।
ভবেতে উদয় ভানু সাহে ফতে আলী॥
উদয় হইতে ভানু তারকা সকল।
আমল আসিতে তারা করে টল টল॥
উদয় হইতে রাত হইল বিদায়।
আন্ধারে নিদ্রিত ছিল জাগিল সবায়॥

হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ আলী ওয়াইসী ক্বেবলা (রহঃ) এর সহিত প্রথম দিদার লাভের পর হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) আপাততঃ সেই দিনের মত বিদায় গ্রহণ করিলে তাঁহার মধ্যে অপূর্ব ঐশ্বরিক আত্মিক জাগরণ সৃষ্টি হইল এবং নব চেতনার উন্মেষ ঘটিল। হযরত ওয়াইসী হুজুর পাক (রহঃ) কে বার বার দেখিবার জন্য তাঁহার প্রাণ ছটফট করিতে লাগিল পড়ালেখা কিছুতেই ভাব লাগে না। হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী পাকের প্রেমে তাঁহার অন্তরে উথাল-পাথাল ঢেউ খেলিয়া চলিল। প্রেমানুরাগে দুই কুল ছাপাইয়া উছলিয়া পড়িতে লাগিল। তিনি নিজেকে আর স্থির রাখিতে পারিলেন না। তীব্র আকর্ষণে ব্যাকুল হৃদয়ে বিবি সালেটের মসজিদে হুজুর ক্বেলার খেদমতে উপস্থিত হইলেন।

এই সময় ঐশ্বরিক প্রেমে বেকারার হইয়া নিজেকে তিনি তাঁহার কদম মোবারকে সম্পূর্ণ রূপে উৎসর্গ করিয়া ভক্তি ও বিনয়ের সহিত অনতি দূরে দন্ডায়মান হইয়া হৃদয় বিগলিত অশ্র“ ধারায় বুক ভাসাইতে লাগিলেন। সেখানে উপস্থিত সকলে তাঁহার এহেন করুণ অবস্থা দর্শন করিয়া হতবাক হইয়া গেলেন। এত ছোট বালক এখানে কি চায়? হুজুর ক্বেবলা বালকের পূত পবিত্র মনের বাসনা ঠিকই অনুধাবন করিয়াছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ তাঁহার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া অন্তদৃষ্টি দ্বারা তাঁহার সারা জীবনের লিখন লাওহে মাহফুজের পাতা পাঠ করিয়া স্নেহ ভড়া কন্ঠে তাঁহার সন্নিকটে বসিতে নির্দেশ দান করিলেন।

আধ্যাত্মিক রাজ্যের কুতুবুল এরশাদের রূহানিয়াতের তাজাল্লী পূর্ণ হায়বতে বা প্রভাবে হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) প্রভাবাম্বিত ও অভিভূত হইয়া হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর নির্দেশ পালন করিতে ক্রন্দনরত অবস্থায় বসিয়া পড়িলেন। অতঃপর হযরত ওয়াইসী ক্বিবলা কা’বা কেবল মাত্র নয় বৎসর বয়সে ত্বরিকত দান করিয়া তাঁহাকে স্বীয় মুরিদ হিসাবে গ্রহণ করিলেন। অতিশয় আগ্রহের সহিত তাঁহার আকাঙ্খিত ও যোগ্য পাত্রে ফয়েজ নেসবত দান করিলেন। সেই সময়ে তিনি বলিলেন, ‘হে বাবা জানশরীফ’! আমি দেখিতেছি, আরশে মুয়াল্লায় আপনার নাম ‘শাহ আহম্মদ আলী; লেখা রহিয়াছে। আজ হইতে আপনা নাম আল্লাহ তায়ালার দরবার হইতে ‘শাহ্ আহম্মদ আলী’ প্রদত্ত হইল।”

‘শাহ্’ শব্দের অর্থ উচ্চ, বাদশা, সুলতান, অধিকারী। ‘শাহ্ আহম্মদ আলী’ অর্থ উচ্চস্তরের কামালিয়তের বাদশাহ্, উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক জগতের বাদশাহ্, উচ্চস্তরের কামেল পীর। হযরত ওয়াইসী হুজুর আরও বলিলেন, “আজ হইতে আপনি সেই আরশে মুয়াল্লায় লেখা ‘শাহ্ আহম্মদ আলী’ নামে অভিহিত ও পরিচিত হইবেন। আপনাকে এই মহামূল্যবান ‘লকব’ দান করা হইল। সুবহানাল্লাহ!”

নদী যেমন চঞ্চল ও অশান্ত গতিতে ছুটিয়া বিশাল সাগরের বুকে নিজেকে সমর্পণ করিয়া নিজের গতি হারাইয়া ফেলে। তেমনি হযরত শাহ্ আহম্মদ আলী ওরফে হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রহঃ) নিজের সঠিক গন্তব্য স্থলে উপনীত হইয়া স্থিরতা লাভ করিলেন, অশান্ত মন এখন স্থির ও প্রেমানুরাগে পরিপূর্ণতা লাভ করিল। পরশের স্পর্শে তিনি যেন নিজেই স্বর্ণ হইয়া মূল পরশে রূপান্তরিত হইলেন। তখন হইতে তিনি অন্তরে প্রশান্তি ও আত্ম-বিশ্বাস লাভ করিলেন, যাহা স্বরচিত ‘ছফিনায়ে ছফর’ কিতাবের ‘মদত রূহানী’ অধ্যায়ে উল্লেখ করিয়াছেন-

“ধরিবে গুরুর পদে সিংহাসন যার।
লড়িবে না হেলিবে না এ ভবেতে আর॥
গুরু সুতে গাঁথা গেছে যে দানা চন্দন।
এক সনে আর রবে হবে না মরণ॥
চন্দন গলার মালা গাঁথা গেছে যার।
খসিয়া পড়িতে নারে থাকিতে সংসার॥

বায়াত গ্রহণের কারণ -

কোরয়ানুল করীমে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এরশাদ করিয়াছেন: “বল, আমার নামাজ, আমার কোরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু-সবই যে শুধূ আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের জন্যই।” (সূরা আনআম, আয়াত: ১৬৩)

মোর্শেদ ক্বেবলার সান্নিধ্যে -

“হে বন্ধু! গুরু পদ ভক্তি কর, ধর্ম জ্ঞান লাভ করিতে পারিবে। গুরুর মহিমা জানিতে পারিলে ধর্মের ফল প্রাপ্তি হইবে। তাই ইসলাম ধর্মের ফল গুরুর হস্তে অর্পন করা হইয়াছে। ইহা কোরআন তত্ত্বজনক দ্বীন মোহাম্মদী নূরী বা সনাতন ধর্ম নামে অভিহিত হইয়াছে। ইহা ব্যতীত কাহারও পরকালের মুক্তির আর কোন পথ দেখা যাইতেছে না।”

এই প্রসঙ্গে মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রহঃ) বলিয়াছেন-
“দস্তে উ রা হক্ চু দস্ত খেশখান্দ
তা ইয়াদুল্লাহ ফওকা আইদিহিম বখান্দ।”

অর্থাৎ- আল্লাহতায়ালা পীরের হাতকে নিজের হাতের সহিত তুলনা করিয়াছেন, এমনকি (আল্লাহতায়ালা বলিতেছেন) তাঁহার নিজের হাত পীরের হাতের উপর রহিয়াছে। সোবহানাল্লাহ॥ সংসার, পৃথিবীর বাহিক্য চাক-চিক্যের প্রতি উদাসীন, অমনোযোগী হইয়া স্বীয় মোর্শেদ ক্বেবলার সান্নিধ্য এবং রূহানী তাজল্লী ও ফায়েজের প্রতি সীমাহীন অনুরাগে অতীব আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন। শয়নে-স্বপনে, নিদ্রা-জাগরণে মোর্শেদ ক্বেবলার মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূল পাক (সাঃ) এর সন্তষ্টি অর্জন করাই ছিল তাঁহার একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।

হযরত আহম্মদ আলী সুরেশ্বরী (রহঃ) তাঁহার ‘নূরেহক্ব গঞ্জেনূর’ কিতাবে তাঁহার পীর সম্বন্ধে লিখিয়াছেন-

“মাণিক পীরে দুধ কলায় ঈমান যাবে ভাই।
মাণিক পীর কোন্ খোদা, খোদা বুঝি নাই॥
মাণিক উছিলা মোর দুধ কলা তার।
তাঁহার দোয়াতে মোর হইবে উদ্ধার॥

হযরত বাবা ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) স্বীয় মুরদগণের সঙ্গে লইয়া প্রত্যহ ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর হালকা জিকির করিতেন। তিনি মুরিদগণেকে স্ব-স্ব যোগ্যতা ও প্রয়োজন অনুযায়ী মারেফতের ছবক প্রদান করিতেন। হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) পীর-মোর্শেদের সান্নিধ্যে যাওয়ার প্রথম দিন হইতেই তাঁহার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেন। তিনি মোর্শেদের খানকাহ্ শরীফে অনুষ্ঠিত মাহ্ফিলে প্রতিনিয়ত যোগদান করিয়া বিশেষ আত্মিক আনন্দ লাভ করিতেন। এই কারণে তিনি প্রতি দিনই মোর্শেদের খেদমতে হাজির হইতেন। মাদ্রাসা হইতে মোর্শেদ পাকের খানকাহ্ শরীফ খুবই কাছাকাছি অবস্থানের কারণে মাত্র অল্পক্ষণের মধ্যেই পদব্রজে সেথায় পৌঁছিয়া যাইতেন।

এইভাবে মোর্শেদ পাকের প্রতি তাঁহার এশ্ক ও মহব্বত ক্রমশঃ বাড়িয়া চলিল। এশ্কের আতিশয্যে তিনি এতই বেকারার হইয়া যাইতেন যে, নিজের সম্বন্ধে কোন খেয়াল থাকিত না। এক সময় তাঁহার এমন ভাবান্তর ঘটিয়াছিল যে তাঁহার চলা ফেরা ও জীবনের ধারা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল। কিশোর সুলভ আচরণ ও খেলাধুলার প্রতি তিনি সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। সর্ব্বদা জিকির ও মোরাকাবা-মোশাহাদায় অস্থির আর তাজাল্লীয়ে এলাহীতে ডুবিয়া থাকিবার দরুন তাঁহাকে ভিন্ন জগতের মানুষ বলিয়া মনে হইত।

সরল প্রাণ, শিষ্টাচার পূর্ণ আচরণ, অভূতপূর্ব্ব ও ভক্তির কারণে আশেকে মাওলানা হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রহঃ) কে হযরত ওয়াইসী পীর ক্বেবলা (রহঃ) অত্যন্ত  স্নেহ ও মহব্বতের দৃষ্টিতে অবলোকন করিতেন। স্বীয় মোর্শেদ ক্বেবলা তাঁহার উপর অতিশয় সন্তুষ্ট ও দয়াবান ছিলেন।

তিনি তাহা অনুধাবন করতঃ স্বরচিত ‘নূরেহক্ব গঞ্জেনূর’ কিতাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন-

“ যে জন পীরের ভাব চাহে বুঝিবারে।
আহম্মদি ভাব বিনা পাইবে না তারে॥”

তাঁহার মোর্শেদ হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী পাকের এশ্ক মহব্বতে বেকারার বেহুঁশ হওয়ায় দয়ালপাক মাহবুবে খোদা হযরত জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রহঃ) এর এমন হাল প্রকাশিত হইল যে, মাদ্রাসার বাহিরে পরিচিত ব্যক্তিবর্গ, মাদ্রাসার অভ্যন্তরে সহপাঠী ও শিক্ষকগণের মধ্যে তিনি ‘আশেকে এলাহী’ বলিয়া পরিচিত হইয়া উঠেন। এলমে মারেফাতের জ্ঞান রাজ্যে তিনি যত বেশি অগ্রসর হইতে লাগিলেন, ততোধিক আসক্ত হইয়া তিনি গভীরতর ঐশ্বরিক জ্ঞান রাজ্যে প্রবেশ করিতে চেষ্টা করিতেন। এই লক্ষ্যে তিনি নিজ মোর্শেদ ক্বেবলার দরবারে প্রতিদিনের মাহফিলে যোগদান করিয়া কল্পনাতীত ভাবে মোর্শেদ ক্বেবলার অসীম ভাব-মহব্বত, ফায়েজ রহমত লাভ করিতেন। মোর্শেদের রহমতী নেক নজরের বরকতে তিনি মারেফত জগতের অপরিসীম পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হইয়াছিলেন।

মোর্শেদ ক্বেবলার প্রতি তাঁহার ভক্তি ও প্রেমানুরাগ ক্রমান্বয়ে এতই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল যে, প্রায়শঃ তিনি মাহফিলে সমাপ্তির পর স্বীয় আবাস স্থলে না ফিরিয়া নিজ পীর-মোর্শেদ ক্বেবলার পবিত্র চরণে খেদমত ও আধ্যাত্মিক সাধনায় বিনিদ্র রজনী কাটাইয়া দিতেন। এই ভাবে তিনি মোর্শেদ ক্বেবলার সন্তুষ্টি অর্জন পূর্ব্বক তাঁহার করুণা প্রাপ্ত হইয়া অতিশয় দ্রুত মারেফত জগতের উচ্চস্তরের মঞ্জিল ও মরতবা সমূহ অতিক্রম করিয়া ‘গাউস’ ও ‘কুতুবুল এরশাদ’ মাকামের অধিকারী হইয়াছিলেন।

Additional information