ওয়াইসী (রহঃ) এর পীর সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

  • Print

হযরত ওয়াইসী  (রহঃ) এর  পীর হাজী হযরত সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ

হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর পীর ছিলেন চট্টগ্রামের হাজী গাজী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ)। তিনি ছিলেন এক মহান অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন পুুরুষ। চট্টগ্রামের মিরেশ্বরেতে তাঁহার মাজার শরীফ অবস্থিত। হযরত সাইয়েদ আহমাদ বেলরভির তিনি ছিলেন শিষ্য ও খলিফা। তিনি তাঁহার পীর হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহমাদ বেলরভি’র সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন। সে সময় ব্রিটিশ শাসনে ভারত উপমহাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় অত্যন্ত দূরাবস্থায় পড়ে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালনে তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। মুসলিম সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি নানাভাবে ক্ষুন্ন হতে থাকে সেই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহমাদ বেলরভী ও তাঁহার শিষ্যরা মানষিক অশান্তি ভোগ করেছিলেন। তাঁহারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ঊনবিংশ শতকের কৃষক বিদ্রোহ, ফরাজী ও বারাসাত বিদ্রোহ নীল বিদ্রোহ ছিল সেই জেহাদের বহিঃপ্রকাশ।

ফলে সকল সম্প্রদায়ের মিলিত প্রয়াসে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এই আন্দোলনের এক প্রান পুরুষ ছিলেন হযরত শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) তাঁহার জীবন আধ্যাত্ম সাধনা ও দেশের মুক্তি এই উভয় প্রকার সত্ত্বা সমম্বিত জীবন।

হযরত শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) পূর্ব পুরুষগণ আফগানিস্থানের গজনীর বাসিন্দা ছিলেন কিভাবে তাঁহারা গজনী থেকে বাংলাদেশে আসেন সে সম্পর্কে জনমনে আজও এক সুন্দর কাহিনী বিধৃত আছে।


হযরত সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী ছিলেন গজনীর সুলতানের একমাত্র পুত্র যুবরাজ বখতিয়ার কুতব আলমের সপ্তম পুরুষের বংশধর। অতি অল্প বয়সে বখতিয়ার কুতুবে আলম যখন পিতার সম্পত্তি তাঁহাকে প্রত্যর্পন করার জন্য মামাকে অনুরোধ জানালেন তখন তিনি তা তাকে প্রদান করতে অস্বীকৃত হলেন। আরও পরিতাপের বিষয় হল এই যে মামা তাঁহাকে কেবল সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলেন তাই নয়, সে দেশ থেকেও তাকে বলপূর্বক বহিস্কার করলেন। ভগ্নহৃদয়ে হযরত বখতিয়ার কুতুবে আলম নিজ পুত্র ফিরোজ শাহ্ কন্যা ময়মুনা খাতুন ও দেশের কিছু সম্মানীয় ব্যক্তিসহ দিল্লীর দরবারে চলে এলেন। সম্রাট তাঁহাকে সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেন। সম্রাট তাঁহাকে গৌড়ের অধিপতি করে দিলেন। হযরত বখতিয়ার কুতুবে আলম তাঁহার মাত্রারিক্ত ক্ষমতার স্বাক্ষর রাখেন। হযরত নিজামপুরী এই বংশেই জন্মান। তাঁহার পিতা ছিলেন মোহাম্মদ পানাহ। 

হযরত শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ ১২০৫ হিজরী, ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁহার শিক্ষাজীবন শুরু হয় পিতার নিকট। গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষালাভের সময় হযরত শেখ জায়েদ রহমান পারগণসেরের কাছ থেকে তিনি অধ্যাত্ম শিক্ষায় দীক্ষিত হন। তারপর উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য তিনি কলকাতায় আসেন। তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পাশ করার পর তিনি এখানেই মাদ্রাসা শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। তিনি এই শিক্ষালায় থেকেই তফসির ও হাদিস সম্পর্কিত উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তিনি সকলকে শ্রদ্ধা করতেন। সর্বশক্তি আল্লাহর সেবায় তিনি নিজেকে সমর্পণ করেন। অসুস্থ ও দুর্বলকে ভালোবাসা হল মহোত্তম কর্তব্য। এক নামাজের পর তিনি অপেক্ষা করে থাকেন পরবর্তী নামাজের জন্য। তিনি সমানুযায়ী সকল কাজ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি সারাজীবনে কখনও জুম্মা নামাজের আগে মধ্যাহ্ন ভোজন করন নি। হাসিমাখা মুখে সকলের সঙ্গে সদা ব্যবহার করতেন। জীবনে একাধিক বার তিনি পবিত্র হেরমাইন শরীফ (মদিনা) ও মক্কা শরীফে পরিভ্রমণ করেন।

সকল মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন উদার দয়াপ্রবণ। ঈশ্বরের তপস্যায় তিনি সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। অসুস্থ ব্যক্তিদের সেবা যত্ন করাই ছিল তাঁহার জীবনের মহান কর্তব্য। প্রয়াতদের জানাজায় তিনি যথোপযুক্তভাবে যোগ দিতেন। এই কাজকে মহান কর্তব্য বলে মনে করতেন। তিনি সব মানুষের সঙ্গে খুশি মনে মিশতেন। তাঁহার পরিধানে থাকত সাদা চাদর ও সাদা পাগড়ি। মোর্শেদ বার হক গ্রন্থে বর্ণনা অনুযায়ী হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী রাত্রে যে স্বর্গীয় স্বপ্ন দেখেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। পয়গম্বরর হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) তাঁহাকে এক শুভ সংবাদ দেন। পয়গম্বর (সাঃ) তাঁহাকে আদেশ করে বলেন, তাঁহার পুত্র সাইয়েদ আহমাদ কলকাতায় আসবে এবং তাঁহার হাতে বায়াত হবে। নিজের আধ্যাত্মিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে তিনি পীরের নিকট থেকে সর্বোচ্চ খলিফার সম্মান লাভ করবেন।


তারপর সাইয়েদ নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) তাঁহার পীর হযরত সূফী সাইয়েদ আহমাদ বেলরভির সান্নিধ্যে দীর্ঘকাল থাকেন। রাজা রঞ্জিৎ সিং ব্রিটিশদের সাথে হযরত সাইয়েদ শাহীদ আহমাদ বেলরভী যুদ্ধ করেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর কৃপায় তিনি প্রভুত শক্তির অধিকারী হন। ফলে চতুর্দিক থেকে প্রাপ্ত অস্ত্রে তিনি হয়ে ওঠেন বলীয়ান। শক্রর বিরুদ্ধে তাঁহার হাতের অস্ত্র তিনি প্রয়োগ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সব্যসাচীর মত নিজের জায়গায় স্থির ছিলেন। কিন্তু কোন এক যুদ্ধে দুর্ভাগ্যবশত তাঁহার বাম হাত অকেজো হয়ে যায়। তাঁহার পীর হযরত সাইয়েদ আহমাদ বেলরভি পাঞ্জাবের যুদ্ধে শহীদ হন, সঙ্গে হযরত ওয়াইসী পীরের পিতা ও শহীদ হন। তাঁহার পীরের সহযোগী হিসেবে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় স্বাধীনতা সংগ্রাম ও যুদ্ধে অতিবাহিত করেন। এজন্য তিনি বিবাহ করার সময় পাননি। আজীবন তিনি চিরকুমার থেকে যান। তাঁহার জীবনে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে।

ব্রিটিশ সরকার তাঁহাকে বহুবার গ্রেপ্তার করতে সচেষ্টা হয় কিন্তু অলৌকিক ঐশ্বরিক শক্তি বলে প্রতিবারই রক্ষা পান। হযরত সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরীর অলৌকিক শক্তিতে ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে পড়ে। জুম্মার নামাজের দিনে মসজিদে ‘খোদবা’র (শুক্রবার) সময় তিনি জনসাধারণকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজ সরকারের চোখকে ফাঁকি দেবার জন্য তিনি প্রায়ই গৃহ বদল করতেন। তাঁহার এক দত্তক পুত্র ছিল নাম আব্দুল্লাহ।

হযরত সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী দেহ ত্যাগ করে ১২৭৫ হিজরি, ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ ১৩ই কার্তিক ১২৬৬ বঙ্গাব্দে। হযরত সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরীর দেহ সমাধিস্থ করা হয় চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত মিরেশ্বরাই এর মালিয়াস গ্রামে। তাঁহার নামানুসারে মাজার শরীফের রাস্তা বর্তমানে সুফীয়া রোড নামে পরিচিত। এই পথ ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের প্রধান সড়ক ধরে মিরেশ্বরাই হয়ে মাজার শরীফের সঙ্গে মিলে গেছে। মিরেশ্বরাইতে বাংলাদেশ সরকার তার নামে একটি সুন্দর তোরণ নির্মাণ করে দিয়েছেন। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবার পথে মিরেশ্বরাইতে এই তোরণদ্বার দেখা যায়।

হযরত সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ খলিফা হলেন হযরত সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ)। প্রতি বৎসর ১৩ কার্তিক হযরত সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) এর উরস মোবারক উদযাপিত হয়ে আসছে তাঁহার মাজার শরীফ প্রাঙ্গনে। তাঁহার আরও বহ খলিফা আছে। দেশ-বিদেশ থেকে বহু ওলামা মাসায়েখ ভক্তরা উরস উপলক্ষে তাঁহার স্মরণ সভায় সমবেত হন।