রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী মোবারক

  • Print

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী মোবারক

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রেমের জ্বলন্ত নিদর্শন পীরে কামেল রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ)। যে কারণে তিনি লাভ করিয়াছেন সম্পূর্ণ বিরল “রাসূলেনোমা” উপাধি। আর “দিওয়ানে ওয়াইসী” নামক অনন্য অসাধারণ মহাকাব্য (কিতাব) রচনা করিয়া জগতের বুকে অমর হইয়া আছেন বিশ্ব বরেণ্য সুবিখ্যাত বাঙ্গালি ফার্সী মহাকবি হিসেবে।

বিশ্ববরেণ্য ফার্সী মহাকবি রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর পূর্ব পুরুষগণের আদি নিবাস ছিল আরব দেশের পবিত্র মক্কা নগরীতে। তিনি সাইয়্যেদানা হযরত আলী (রহঃ) ও গাউসুল আজম হযরত বড়পীর মহীউদ্দীন আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ) এর বংশধর। তাঁহার প্রথম পুরুষ ছিলেন কুরাইশ সম্প্রদায়ের হাসেমী গোত্র ভুক্ত। কালের প্রবাহে তাঁহার পূর্ব পুরুষের প্রধান শাখা আরব হইতে ইরাকে এবং সেখান থেকে ইরানে হিজরত করেন। সেখানে কয়েক পুরুষ বসবাস করিবার পর মূল একটি শাখা প্রথমে গজনী অতঃপর দিল্লীতে বসতি স্থাপন করেন। প্রপিতামহের ইহধাম হইতে বিদায় গ্রহণের পর হযরত ওয়াইসী পীর ক্বেবলা (রহঃ) এর পিততামহ দিল্লী পরিত্যাগ পূর্বক বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত আমিরাবাজার নামক গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এই গ্রামেই তাঁহার পিতা ক্বেবলা জন্ম গ্রহণ করেন।

হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের আমিরা বাজারে ১৮২০-১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে শুভ জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সাইয়েদ ওয়ারেস আলী (রহঃ) এবং মাতার নাম হযরত হাফেজা সাইয়েদা সাইদা খাতুন (রহঃ)। মাতার পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর বংশধর। হযরত ওয়াইসী পীর ক্বেবলা (রহঃ) এর জন্ম গ্রহণের পূর্বের চল্লিশ দিবাগত রাতে তাঁহার পিতা মাতাকে হযরত আলী (রহঃ) ও স্বর্গরাণী মা ফাতিমা জাহরা (রহঃ) স্বপ্নে দর্শন দান করিয়া এরশাদ ফরমান যে, নব প্রসূতের নাম যেন ‘ফতেহ আলী’ রাখা হয়। নিজের পবিত্র নামের সহিত মিল রাখিয়া হযরত আলী (রহঃ) এ নামকরণের নির্দেশ দিয়াছিলেন।


অতি শৈশব হইতেই হযরত ওয়াইসী হুজুর (রহঃ) সর্বদা সহাস্য বদনে থাকিতেন। নীরবে একাকী যেন কোন অদৃশ্য বন্ধুকে নিয়া আপন মনে খেলা করিতেন। আজানের সময় নীরব হইয়া হাত-পা নাড়া-চাড়া বন্ধ করিয়া আজানের সুমধুর ধ্বনি শ্রবণ করিতেন। রমজানের দিবাভাগে দুধ বা অন্য কিছু পান করিতেন না। কোন আহার করিতেন না। তাহাতে সকলেই বুঝিতে পারিলেন যে, মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনিও রোজা পালন করিতেছেন। শৈশবে তিনি কখনো উলঙ্গ হইতে চাহিতেন না। যখন তখন মলমূত্র ত্যাগ করিয়া মায়ের পরিধানের কাপড় ও বিছানা অপবিত্র করিতেন না। জন্মলগ্ন হইতেই তাঁহার সুষমামন্ডিত সুনিয়ন্ত্রিত ও রীতিসিদ্ধ আচরণে সকলে অত্যন্ত মোহিত ছিলেন।

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) কৈশরে পদার্পণ করার পূর্বে তাঁহার বীর পিতা তাঁহাদেরকে আল্লাহর হেফাজতে রাখিয়া বালাকোট শিখ সমরে যোগদান করিয়া ধর্ম যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। এর কিছু দিন পরেই তিনি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সহিত আধ্যাত্মিক সিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের অরণ্যে গমন করেন। আল্লাহ পাকের ধ্যানে তাঁহার দিন অতিবাহিত করিতে থাকেন। ক্ষুধা পাইলে গাছের পাতা বা ফলমূল খাইতেন এবং তৃষ্ণা নিবারণে ঝর্ণার স্বচ্ছ সুপেয় পানি পান করিতেন। কখনো কখনো তাঁহাদের জন্য আসিতো স্বর্গের খাদ্য পানীয় ভরা খানচা।

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) গৃহে প্রত্যাবর্তনের কয়েক মাস পরে তাঁহার মাতা তাঁহাকে নিয়া মক্কা শরীফে হিজরত করার মানসে চট্টগ্রাম হইতে কলিকাতা অভিমুখে জলপথে যাত্রা করেন। কিন্তু অতি মর্মন্তদ যে, কলিকাতার অনতি দূরে হুগলী নদীর মোহনার নিকটবর্তী এলাকায় জাহাজ ডুবি হইয়া তাঁহার মাতা পরলোক গমন করেন। আল্লাহ পাকের অসীম রহমতে হযরত খাজা খিজির (আঃ) আসিয়া হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) কে উদ্ধার করিয়া হুগলী নদীর মোহনার তীরবর্তী লোকালয়ে রাখিয়া যান।


রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কোন বিষয় একবারের বেশি দ্বিতীয় বার পড়ার প্রয়োজন হইত না। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনে ক্বারী হইয়াছিলেন। তাঁহার আধ্যাত্মিক শিক্ষার হাতে খড়ি হইয়াছিল নিজ পিতা ক্বেবলা কামেল অলি হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সাইয়েদ ওয়ারেস আলী (রহঃ) এর সান্নিধ্যে। মাত্র চার থেকে সাত বছরের মধ্যে তিনি কাদেরিয়া, চিশ্তীয়া, নকশেবন্দীয়া, মোজাদ্দেদীয়া ত্বরিকায় প্রাথমিক ভাবে দীক্ষা প্রাপ্ত হইয়া হৃদয়কাড়া পুষ্পের ন্যায় আকর্ষনীয় হৃদয়গ্রাহী সুগন্ধি বিলাইতে শুরু করেন।

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) প্রথমে হুগলী শহরের হাজী মুহাম্মদ মহসিন মাদ্রাসায় বিদ্যাশিক্ষা করেন। তিনি অতিশয় মেধাবী ছিলেন বলিয়া সরকারী বৃত্তি সহকারে উক্ত মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন। এখানে তিনি পবিত্র কোরআনের তাফসির, হাদিস শরীফ, ফেকাহ, অসুল, মান্তেক প্রভৃতি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি আরবী, উর্দু ও ফার্সী সাহিত্যে প্রভূত পান্ডিত্য অর্জন করেন।

তিনি প্রকাশ্য ভাবে যাবতীয় নিসবত অর্জন করিবার মানসে হাজী গাজী হযরত শাহ্ সূফী নূর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ) এর নিকট গমন করেন। তিনি তাঁহারপবিত্র হস্তে বায়াত গ্রহণকরিয়া তাঁহার শিষ্যত্ব বরণ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কাদেরিয়া, চিশ্তীয়া, নকশেবন্দী ও মোজাদ্দেদীয়া ত্বরিকার খেলাফত অর্জন করেন।


হযরত বাবা ওয়াসী ক্বিবলা কা’বা (রহঃ) কৃচ্ছ সাধন ও মোরাকাবা মোশাহেদার মাধ্যমে দিনাতিপাত করিতেন। তাঁহার প্রাত্যহিক ইবাদত বন্দেগীর বিবরণ তুলিয়া ধরা কাহারো পক্ষে সম্ভব নয়। বাহ্যিক ভাবে যতটুকু দেখা গিয়াছে তাহা তুলিয়া ধরা হইল-

ফজরের নামাজান্তে ওজিফা, দরূদ শরীফ পাঠ ও কোরআন তেলাওয়াত করিতেন। সারারাত জাগিয়া ইবাদত করিতেন। তিনি দরূদ শরীফকে অধিক গুরুত্ব দিতেন। সমস্ত ইবাদতের মধ্যেই তিনি রাসূল পাক (সাঃ) এর মহব্বতে বেকারার থাকিতেন। প্রাত্যহিক ওয়াক্তের নামাজের ন্যায় এশরাক, চাশত, তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করিতেন। রমজানে রোজা রাখিতেন, শবে কদরে এতেকাফে বসিতেন, শবে বরাত ও আশুরায় রোজা পালন করিতেন। আশুরা, শবে বরাত, শবে মিরাজ, আখেরী চাহারশোম্বা, ফাতেহা-ই-দোয়াজ দাহম, ফাতেহা-ই-ইয়াজ দাহমে বিশাল আয়োজনে মিলাদ মাহ্ফিল করিতেন। এটা তাঁহার চিরাচরিত, যথারিতী নিয়ম ও অভ্যাস ছিল।

তিনি ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার পুনাশিতে বসত বাড়ি নির্মাণ করিয়া স্ব-পরিবারে বসবাস করিতেন এবং কলিকাতা হইতে মাঝে মধ্যে সেখানে যাইয়া থাকিতেন। তিনি কলিকাতা শিয়ালদহের নিকটবর্তী মির্জাপুর পার্কের উত্তর দিকে মির্জাপুর ষ্ট্রীট ও আমহার্স্ট ষ্ট্রীটের সংযোগ স্থলের উপর একটি মঠ কোঠতে বসবাস করিতেন। সে সময়ে হযরত খাজা খিজির (আঃ), হযরত মা ফাতেমা (রহঃ), হযরত আলী (রহঃ), হযরত ওসমাণ গণি (রহঃ), হযরত আবুবকর (রহঃ) ও হযরত উমর (রহঃ) আগমন পূবূক তাঁহাকে আপন আপন অমূল্য নিসবত ব্যক্তিগত ভাবে দান করিয়া যান।


এরপর নূরনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) তাঁহার কাছে তাশরিফ আনেন এবং তাঁহাকে অসীম স্নেহে নিজ পুত্র সম্ভাষণে আপন পূতবক্ষে জড়াইয়া ব্যক্তিগত ভাবে আপন পবিত্র ও মহার্ঘ নিসবত দান করিয়া উভয় জগতে মহাভাগ্যবান করেন। পরবর্তী সময়ে নবীজী পুনঃ আবির্ভূত হইয়া এরশাদ ফরমান যে, যখনই তিনি ইচ্ছা করিবেন তখনই নিদ্রা ও জাগরণে নবী পাক (সাঃ) এর জিয়ারত লাভ করিবেন। সে অবধি তিনি “রাসূলেনোমা” উপাধিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। সব সময় তিনি রাসূলেপাক (সাঃ) এর দর্শন লাভ করিতেন। তিনি তাঁহার বহু মুরিদকে রাসূলে পাক (সাঃ) এর দর্শন লাভ করাইয়া দিয়াছেন। হযরত রাসূলে করিম (সাঃ) এর দর্শন লাভের মানসে তাঁহার নিকট আরজ পেশ করিলে তিনি দয়াপরবশ হইয়া তাহাদের মনোবাসনা পূর্ণ করিতেন। আধ্যাত্মিক বা রূহানী জগতে ওয়াইসীয়া নামে অতিশয় মর্যদাপূর্ণ ও প্রবলতম আধ্যাত্মিক রূহানী শক্তি সম্পন্ন খোদা প্রাপ্তির একটি অতি উত্তম ত্বরিকা রহিয়াছে। অতি অল্প সংখ্যক আউলিয়া এটা লাভ করিয়াছেন। কেহ স্বেচ্ছায়, আকাঙ্খা বা প্রার্থনা করিয়া এটা লাভ করিতে পারে না। এটা শুধুমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার এনায়েত, ফরজ ও রহমতের দ্বারা লাভ করা যায়। সম্পূর্ণ রূপেই তা আজলী তকদিরি রূহানী সম্পর্ক। রাসূলেনোমা হযরত ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) হযরত ওয়ায়েস করণী (রহঃ) হইতে রূহানী দীক্ষা ও শক্তি লাভ করিয়া ওয়াইসীয়া ত্বরিকার ফয়েজ, নেজবত ও খেলাফত লাভ করিয়াছিলেন।

এছাড়া তিনি মাসুমীয়া ও সোহরাওয়ার্দীয়া ত্বরিকার খেলাফতও লাভ করেন। তিনি সর্বমোট ৭টি ত্বরিকা যথা- কাদেরিয়া, চিশ্তীয়া, মোজাদ্দেদীয়া, নকশেবন্দীয়া, ওয়াইসীয়া, মাসুমীয়া ও সোহরাওয়ার্দীয়া ত্বরিকার খেলাফত লাভ করেন এবং এই সাতটি ত্বরিকাতেই তিনি মুরিদ করিতেন।

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহঃ) মারেফাতের উচ্চ শিখরে উন্নীত হইয়া খোদাতায়ালার অসীম রহমতে প্রথমত তিনি কুতুবুল এরশাদ নামক উচ্চ পদটি লাভ করিয়াছিলেন। অতঃপর ক্রমশ আধ্যাত্মিকতার আরো উচ্চ শিখরে আরোহণ করিয়া ফরদিয়াতের মোকামে উন্নীত হইয়া ফরদ হইয়াছিলেন। পরে তিনি সমধিক উন্নত হইয়া কুতবুল ওয়াদত নামক অতি সুউচ্চ পদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। একদা রমজান মাসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কর্তৃক তিনি বঙ্গ, আসাম ও বিহারের প্রধান কুতুবুল আলম পদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এরপর তিনি গাউসে জামান পদ প্রাপ্ত হন। তিনি মুহূর্তের মধ্যে আপন অস্তিত্ব ভুলিয়া হযরত রাসূলে পাক (সাঃ) এর মধ্যে একাকার হইয়া যাইতেন বলিয়া তাঁহাকে ‘ফানাফির রাসূল’ নামে অলংকৃত করা হয়।


তিনি কলিকাতা হাইকোর্টের ফার্ম বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা পদে চাকরি নেন। তখন থেকেই তিনি জন সাধারণকে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষা দিতে থাকেন এবং মুরিদ করিতে আরম্ভ করেন। এরপর তিনি পার্ক সার্কাসের কড়েয়া রোডের আহমদ কসাইয়ের মসজিদের নিকটবর্তী জনাব বেগ সাহেবের ‘বেগ বাগান রো’ কুটিরে স্বপরিবারে বসবাস করিতেন। পরবর্তীতে তিনি কলিকাতা মেটিয়া বুরুজে অবস্থানকারী অযোধ্যার পদচ্যুত বিখ্যাত নওয়াব শাহ্ ওয়াজেদ আলীর প্রাইভেট সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত হন। অতঃপর তিনি পলিটিক্যাল পেনশন অফিসের সুপারেনটেন্ডের পদে যোগদান করেন। এই সময় হইতে তিনি বিবি সালেটের মসজিদ সংলগ্ন কুঠিতে বসবাস করিতে থাকেন। অতিশয় দায়িত্ব পূর্ণ ও সম্মান জনক ভাবে চাকরি জীবন সমাপ্ত পূর্বক তিনি জন সাধারণকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা প্রদানের জন্য সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

কীট-পতঙ্গ যেমন মরিয়া হইয়া শিখার পানে ধাবিত হয়, তেমনি বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ, পাঞ্জাব ভূপাল এমন কি সুদূর বলখ, বদাখশান, খোরাশান ও মদিনা শরীফ হইতে মানবকুল সমাগম হইয়া ‘সিরাতুল মুস্তাকিম’ পাওয়ার আশায় তাঁহার পবিত্র হাতে বায়াত হইতে লাগিল।

তিনি তাঁহার ৩৫ জন মুরিদ খলিফা প্রত্যেকেই রাসূল করিম (সাঃ) এর প্রেম, ভালবাসা, আনুগত্য ও আধ্যাত্মিক জগতের পূর্ণ শিক্ষা-দীক্ষা দান করিয়া পরিপূর্ণ ভাবে কামেল পীরের মর্যদা দান করেন। তাঁহার ৩৫ জন বিশিষ্ট মুরিদ ও খলিফার নাম পবিত্র ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ কিতাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।


তাঁহাদের মধ্যে কয়েক জন বিশিষ্ট মুরিদ ও খলিফা হইলেন হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সাইদেয় আমজাদ আলী (রহঃ), শামসুল ওলামা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফীসাইয়েদ আহমদ আলী ওরফে শাহ্ সূফী সাইয়েদ জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রহঃ), হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী সাইয়েদ মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকী (রহঃ), শামসুল ওলামা হযরত মাওলানা শাহ্ সূফী গোলাম সালমানী (রহঃ), শামসুল ওলামা মাওলানা মির্জা আশরাফ আলী (রহঃ), হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ওয়াজেদ আলী (রহঃ), হযরত মাওলানা সাইয়েদ আজম হুসাইন (রহঃ) প্রমুখ। ইহা ব্যতীত ঝাঁকে ঝাঁকে লাখে লাখে জ্বীনও রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর পদ প্রান্তে নিজেকে সঁপিয়া দিয়াছিলেন।

‘বেগ বাগানরো কুটিরে অবস্থান কালে রাসূলেনোমা হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) ফার্সী ভাষায় ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ কিতাব খানি রচনা করেন। অতি উচ্চাঙ্গের মৌলিক এই মহাকাব্যে হযরত রাসূলে করিম (সাঃ) এর এশকে মধুর প্রেমপূর্ণ, ঝংকার সম্পন্ন আধ্যাত্মিক লহরীময় গযল ও কাসিদা রহিয়াছে। মহাকাব্যটি রচনা করিয়া তিনি ফার্সী মহাকবি হিসাবে সমগ্র বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেন। তাসাউফ পন্থী আশেকে রাসূল (সাঃ) গণের জন্য এই কিতাব খানি মহা মূল্যবান ও অত্যন্ত জরুরি।

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর পবিত্র ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ মহাকাব্যে একটা বিষয় পরিষ্কার ভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে যে, নবী করিম (সাঃ) এর প্রতি প্রেম ভালবাসার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন ও নাজাত পাওয়ার একমাত্র পথ। তিনি তাঁহার ভক্ত অনুসারী গণকে সর্বদা নবী করিম (সাঃ) এর প্রেম ভালবাসার ও যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দিতেন।


রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) নিজ আয়ের এক-তৃতীয়াংশ সংসার পরিচালনার জন্যে ব্যয় করিতেন। বাকি টাকা অসহায় নিরন্ন, দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করিতেন। তিনি খুব সামান্য আহার করিতেন শুধু জীবন রক্ষার নিমিত্তে যতটুকু প্রয়োজন। রসনা বিলাসের নিমিত্তে কখনো আহার করিতেন না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নয়নমণি হযরত ইমাম হাসান (রহঃ) ও হযরত ইমাম হোসাইন (রহঃ) এর কথা স্মরণ করিয়া তিনি কখনো তিন চুমুকের অধিক পানি পান করিতেন না। কারবালার কথা স্মরণ করিয়া তিনি আহাজারি ও রোদন করিতেন।

হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর ওফাতের দুই মাস পূর্বেই তাঁহার অন্যতম প্রিয় মুরিদ ও খলিফা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহম্মদ আলী সুরেশ্বরী (রহঃ) ২০ শে আশ্বিন কাশ্ফে দেখিতে পাইলেন যে, সমস্ত আকাশে লক্ষ লক্ষ তারকা আনন্দে মুখরিত। এ সম্পর্কে হযরত সুরেশ্বরী স্বরচিত ‘ছফিনায়ে ছফর’ কিতাবে লিখিয়াছেন-

মনে আসে আশ্বিন মাসে জুড়িয়া আকাশ।
লক্ষ লক্ষ তারাগণ ছোটে পাশাপাশ॥

ঝাকে ঝাকে তারাগণ ছুটিয়া বেড়ায়।
একদিক হতে তারা আর দিকে যায়॥

আগত হইতে নিশি লাগাত প্রভাত।
দিকে দিকে তারা খেলা ছিল সারা রাত॥

ঘর বার আমাদের ছিল আগমন।
ছিল না মনের শান্তি শরীরে বসন॥

হুতাসে মনের শান্তি নাশিতে কেবল।
নিশি ভর ছিনু সবে যেমন পাগল॥

অশান্তি হইল মম ধৈর্য অনুকুল।
শান্তশীল ছিল মন হইল আকুল॥

তারপরে শীঘ্র গতি কলকাতা নগর।
সেবিবারে পীর পদ মন কলেবর॥

এ বিরসে ধৈর্য সহ্য রহিল না আর।
মনে আশা জিজ্ঞাসিব নিকটে পিতার॥


তারাদের এইরূপ আচরণের অর্থ নিজে অবগত হইতে পারিয়াও হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) স্বীয় মুর্শিদ পাকের নিকট আরজ করিলে তিনি বলিলেন, “এ তো খুশির সংবাদ।” পরক্ষণে তাঁহার চেহারায় মলিনতার ছাপ লক্ষ্য করা গেল।

তখন হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) পুনঃ আরজ পেশ করিলেন, “বাবা! আপনি বলিলেন খুশির সংবাদ অথচ আপনার চেহারা মোবারক মলিন কেন?” তিনি বলিলেন, এটা তাঁহার ওফাতের পূর্বাভাস। তাঁহাকে সঙ্গে পাওয়ার আনন্দে আল্লাহর ফেরেস্তাগণ ও তারকা মন্ডলী আনন্দে আত্মহারা হইয়াছে।

হযরত বাবা ওয়াইসী পীর ক্বেবলার (রহঃ) আদেশে তাঁহার জাহেরান অবস্থায় হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে তাঁহার পবিত্র মাজার শরীফ নির্মাণ করিয়াছিলেন। কারণ হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) নিজ মুর্শিদ ক্বেবলার ওফাতের আলামত জানিতে পারিয়া রোদনরত অবস্থায় নিজ পীর মুর্শিদের নিকট বলিলেন, বাবা! আপনার পর্দা গ্রহণ করিবার পর আমি কেমনে থাকিব। তখন হযরত ওয়াইসী পীর (রহঃ) তাঁহার নিজের জন্য সুরেশ্বর দরবার শরীফে মাজার শরীফ নির্মাণের আদেশ প্রদান করেন। নিজ পীর মুর্শিদ ক্বেবলার জীবদ্দশায় হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) সুরেশ্বরী দরবার শরীফে মাজার শরীফ নির্মাণ করিয়াছিলেন।


এর দুই মাস পরে, হুগলী জেলার তারকেশ্বর নসিপুর রেল ষ্টেশনের নিকটবর্তী মোল্লা সিমলা গ্রামে দাওয়াতে অবস্থানকালে তিনি অসুস্থতা বোধ করেন এবং তিরোধানের আলামত বুঝিতে পারিয়া সাহাবীবর্গকে নির্দেশ দিলেন তাঁহাকে কলিকাতায় নিয়া যাওয়ার জন্য। অন্যান্য মুরিদসহ হযরত শাহ্ আহম্মদ আলী সুরেশ্বরী (রহঃ) তাঁহাকে নিয়া কলিকাতার পথে যাত্রা করেন। ট্রেন হাওড়া ষ্টেশনের নিকটবর্তী হইলে তিনি জিজ্ঞাস করেন, আকাশে রক্ত মেঘের আবির্ভাব হইয়াছে কিনা? সকলে গগণ পানে দৃষ্টিপাত করিয়া আশ্চর্য হইয়া অবলোকন করেন, যথার্থই আসমানে রুধির মেঘের সঞ্চার হইয়াছে। এই বিষয় তাঁহার কর্ণ গোচর করিলে তিনি বলিলেন, অল্পক্ষণ পরেই তিনি বেছাল হক্ব প্রাপ্ত হইয়া পর্দা গ্রহণ করিবেন। এটা তাঁহারই উঙ্গিত। এই সময় তিনি বেশ অসুস্থতাবোধ করেন এবং হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ আহম্মদ আলী সুরেশ্বরী (রহঃ) কে আগাইয়া আসিতে বলিলেন। হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) তাঁহার নিকট আসিলে হযরত বাবা ওয়াইসী পীর ক্বেবলা (রহঃ) বুকে বুক মিলাইয়া দোয়া করিলেন। তৎপর মহব্বতের সহিত তাঁহার ছেরমোবারক হযরত সুরেশ্বরী (রহঃ) বুকে হেলান দিয়া কাঁধের উপর রাখিয়া আরাম অনুভব করিলেন। এই সময় তিনি মহাপ্রভুর ধ্যানে সম্পূর্ণ আত্মস্থ হইয়া যান।

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) ৮ই রবিউল আউয়াল ১৩০৪ হিজরী মোতাবেক বাংলা ১২৯৩ সনের ২০ শে অগ্রহায়ণ বৈকাল ৪ টার সময় ট্রেন হাওড়া ষ্টেশনের প্লাটফর্মে প্রবেশ করা মাত্রই তিনি কলেমা শাহাদত সিগ্ধ স্বরে উচ্চারণ করিয়া সারা জাহানের আপন জন পরিবারবর্গ ও ভক্ত মুরিদ অনুসারীগণকে শোক সাগরে ভাসাইয়া চির অমরালোকে আপন মাবুদের সান্নিধ্যে গমন করেন। তিনি ৬৩ বৎসর হায়াত শরীফে জাহেরান ছিলেন।

রাসূলেনোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়েদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) ইন্তেকালের পরে যথারীতি গোছল করাইয়া কাফন পড়াইয়া কলিকাতা শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ লেনের বিবি সালেটের মসজিদে নেওয়া হয়। সেখানে আত্মীয়-স্বজন, অসংখ্য ভক্ত, মুরিদান ও জনগণ তাঁহাকে শেষবারের মত এক নজর দেখেন এবং জানাজায় শরীক হন। অতঃপর কলিকাতা মাণিকতলার দিল্লীওয়ালা গোরস্থানে হযরত ওয়াইসী পীর ক্বেবলাকে (রহঃ) যথারীতি দাফন করা হয়। ঠিক একই সময়ে বহু লোকের উপস্থিতিতে বাবা ওয়াইসী পীরক্বেবলা (রহঃ) এর পবিত্র দেহ মোবারক যথাযোগ্য মর্যাদায় দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে জানাজা হওয়ার পর পূর্বাহ্নে নির্মিত মাজার শরীফে সমাহিত করা হয়। সেই হইতে আজ পর্যন্ত দরবারে আউলিয়া সুরেশ্বর দ্বায়রা শরীফে তাঁহার মাজার শরীফ সুন্দরভাবে বিদ্যমান ও যথারীতি পরিচর্যা হয় এবং ভক্তগণ উপস্থিত হইয়া জেয়ারত করিয়া ফয়েজ প্রাপ্ত হয়ে আসিতেছেন।